রাজবাড়ি পর্ব ১৭ঃ তাজহাট রাজবাড়ি

ঢাকা। রংপুর। দেশের ভেতর শহর। তার ভেতরে স্মৃতি। কিছু স্মৃতি সংরক্ষিত, কিছু এলোমেলো পড়ে থাকে এদিক-সেদিক। স্থাপত্যরা এমনই স্মৃতির মতো। তাতে সভ্যতার রং লাগে। তবুও তার মলিনতাই ছুঁয়ে যায় আমাদের। ঢাকার রংপুর শহর থেকে প্রায় ছয় কিলোমিটার দূরে অবস্থিত তাজহাট গ্রাম।  সেই সবুজ গ্রামে একলা জেগে থাকা তাজহাট জমিদারবাড়ি।

বাংলাদেশের তাজহাট গ্রামে বাস করতেন রত্ন ব্যবসায়ী মান্নালাল। তিনি ছিলেন এই জমিদারবাড়ির প্রতিষ্ঠাতা। প্রাসাদসমান জমিদার বাড়ি তৈরি করিয়েছিলেন এই ব্যবসায়ী। অষ্টাদশ শতাব্দীতে রংপুরের মাহিগঞ্জে এসে বসবাস শুরু করেছিলেন মান্নালাল। সেখানেই তৈরি করা হয় এই বিশাল ভবন। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে ধ্বংস হয়ে যায় মান্নালালের প্রিয় জমিদারবাড়ি। মান্নালাল ছিলেন সন্তানহীন। এই ভূমিকম্পে ভয়াবহ আহত হয়েছিলেন ব্যবসায়ী মান্নালাল। ভূমিকম্প পরবর্তী সময়ে কিছুদিন বেঁচে থাকলেও তাঁর শারীরিক ও মানসিক ক্ষত তাঁকে আহত করে চলেছিল। তারপর মারা যান তিনি।

মান্নালালের দত্তকপুত্র গোপাল লাল রায় বাহাদুর পিতার স্মৃতির উদ্দেশে প্রায় দুহাজার রাজমিস্ত্রির সহযোগিতায় আবার তৈরি করেন তাজহাট জমিদারবাড়ি। ১৯১৭ সালে সম্পূর্ণভাবে তৈরি হয় এই ভবনটি। প্রাসাদ চত্বরে রয়েছে মাছ গাছের-সারি এবং পুকুর। মান্নালালের উত্তরসূরিরা রাজা হিসেবে পরিচিত ছিল বাংলাদেশে। তাই তাজহাট রাজবাড়ি হিসেবেও পরিচিত রংপুরের এই জমিদারবাড়ি।

জমিদারবাড়ির অপরূপ শোভা মনোগ্রাহী। আধুনিক ধাঁচেই তৈরি এই জমিদারবাড়ি। কথিত আছে উনিশ শতকে তৈরি হওয়া এবং সংরক্ষিত ভাবে টিকে থাকা বাংলাদেশের অন্যতম স্থাপত্য এই তাজহাট রাজবাড়ি। মেহগনি, কামিনী ও আম-কাঁঠাল গাছ ঘেরা এই রাজবাড়ির শোভা অপরূপ। অনেকেই বলেন ঢাকার আহসান মঞ্জিল-এর মত দেখতে এই রাজবাড়ি। তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় রয়েছে রাজা গোপাল লাল রায়বাহাদুরের ব্যবহৃত নানা জিনিসপত্র। এই ভবন লাল ইট, শ্বেতপাথর ও চুনাপাথর দ্বারা নির্মিত। থাকার ব্যবস্থা করা আছে এই রাজবাড়িতে। চারতলা প্রাসাদটি ২১০ ফুটের মত প্রশস্ত। তবে না থেকেও শুধুমাত্র ঘুরে দেখে চলে আসা যায়।

এই রাজবাড়ির গঠন মুঘল স্থাপত্য থেকে অনুপ্রাণিত বলে অনেকেই মনে করেন। রাজবাড়ির ছড়িয়ে যাওয়া দালানগুলোর সঙ্গে রয়েছে মসজিদের সাদৃশ্য। মোট একত্রিশটি সিঁড়ি আছে রাজবাড়িতে। ইতালীয় মার্বেলের তৈরি। তবে সিঁড়ি ও জাদুঘরের সংযোগস্থলের মেঝে অন্য পাথরে তৈরি। এই রাজবাড়িতে একটি গুপ্ত সিঁড়ি আছে যা নাকি সরাসরি ঘাঘট নদীর সঙ্গে যুক্ত। এমনটাই জনশ্রুতি। কিন্তু নিরাপত্তার কারণেই এই সিঁড়ি বর্তমানে বন্ধ।

এই রাজবাড়িতে রয়েছে এ রানীমহল। সে দিক থেকেও স্বতন্ত্রই রাজবাড়ি। এটি আসলে রাজবাড়ি নাকি জমিদারবাড়ি তাই নিয়ে রয়েছে বিভিন্ন মতামত। কোন ঐতিহাসিক বলেন, এটি সম্পূর্ণরূপেই জমিদার বাড়ি। কেউ আবার বলেন, মান্নালালের কোন উত্তরসূরী রাজা উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, রায় বাহাদুর উপাধিও রাজা হিসেবেই তাঁদের দেওয়া হয়েছিল। তাই এই ভবনকে রাজবাড়ি বলা যেতেই পারে বলেই ঐতিহাসিকদের।

১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ এই প্রাসাদকে সংরক্ষিত স্থাপত্য হিসেবে ঘোষণা করে। এরই সূত্র ধরে ২০০৫ সালে রংপুর জাদুঘরকে সরিয়ে এই প্রাসাদের দ্বিতীয় তলায় নিয়ে আসা হয়েছিল। এই প্রাসাদের রয়েছে প্রদর্শনী কক্ষ। দশম ও একাদশ শতাব্দীর টেরাকোটা শিল্প কর্ম দেখতে পাওয়া যায় এই প্রদর্শনী কক্ষে। সংস্কৃত ও আরবী ভাষায় লেখা ঐতিহাসিক পান্ডুলিপিও দেখা যায় এখানে। মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের সময়ে কুরআন সহ মহাভারত-রামায়ণ সুরক্ষিত রয়েছে এখানে।

এই প্রাসাদ রাজবাড়ি নাকি জমিদারবাড়ি তা নিয়ে আলোচনা চলতেই থাকে। রংপুর জাদুঘরের ছুটির দিনে ভিড় হয় মানুষের। এই রাজবাড়ির জন্মকথা নিয়ে যতই বিতর্ক থাকুক, ঊনিশ শতকে তৈরি হওয়া এই প্রাসাদ ঠিক যেন স্মৃতি-ঘর। অতীত আর আধুনিকতার মেলবন্ধন করা স্মৃতির এই তাজহাট জমিদারবাড়ি।

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...