"নবাবী আমল শীতকালের সূর্যের মতো অস্ত গেল। মেঘান্তের রৌদ্রের মতো ইংরেজদের প্রতাপ বেড়ে উঠলো। বড় বড় বাঁশ ছাড় সমূলে উচ্ছন্ন হল। কঞ্চিতে বংশলোচন জন্মাতে লাগলো। নবো মুনসী, ছিরে বেণে ও পুঁটে তেলি রাজা হল।"
কালীপ্রসন্ন সিংহের 'সটিক হুতোম প্যাঁচার নকশা"। তিনি আসলে রাজা নবকৃষ্ণদেবের কথাই বলেছিলেন। এই নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে কোন সন্দেহ নেই। শোভাবাজার রাজবাড়ির রাজা নবকৃষ্ণ দেব ও তাঁকে ঘিরে এই রাজবাড়ির ইতিহাস আলো-ছায়ার মত।
কলকাতা শোভাবাজার রাজবাড়ির আদি পুরুষ ছিলেন শ্রীহরি। ইনি মুর্শিদাবাদ জেলার কর্ণসুবর্ণ গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। শ্রীহরির অধস্তন পুরুষ এবং রাজা নবকৃষ্ণ দেবের প্রপিতামহ রুক্মিনীকান্ত মুড়াগাছা পরগণার অপ্রাপ্তবয়স্ক সাবর্ণ চৌধুরী জমিদার কেশবরাম রায়চৌধুরীর জমি-জমার তত্ত্বাবধায়ক পদে নিযুক্ত হয়েছিলেন। সেই সময়ে রায় চৌধুরী বাড়ির কাছারিতে নায়েব হিসেবে ছিলেন জন অ্যান্টনি নামে এক ফিরিঙ্গি। একবার রুক্মিনীকান্তের বড় ছেলে রামেশ্বর বকেয়া রাজস্ব আদায় করতে সক্ষম হননি। শাস্তি স্বরূপ সাবর্ণ জমিদার কেশবরাম তাঁকে নিজের বাড়িতে কারাবন্দি করে রেখেছিলেন। এই ঘটনার পর রামেশ্বরের দ্বিতীয় পুত্র রামচরণ দেব মুর্শিদাবাদে গিয়ে বাবাকে মুক্ত করেন অর্থের বিনিময়ে। এদিকে রামচরণ দেব তখন বাবার অপমানের প্রতিশোধ নেবার চিন্তায় ব্যস্ত। ধীরে ধীরে কেশবরামের ক্ষমতাও অস্ত যাওয়ার পথে। এই সময় রামচরণ দেব কেশবরামকে কারাবন্দি করেছিলেন। পরে যদিও তিনি কেশবরামকে মুক্তি দিয়েছিলেন, বদলে বুঝে নিয়েছিলেন একটা সারসত্য। কেশবরামের ক্ষমতার ক্ষয় হয়ে যাওয়ার সত্য বুঝতে পেরেছিলেন রামচরণ দেব। তবে এই সময়টুকুতে ওই অঞ্চল ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা তিনি ভেবেছিলেন।
তিনি তখন গোবিন্দপুরে গঙ্গা তীরবর্তী একটি জায়গায় বসবাস শুরু করেন। সে সময় নবাব আলিবর্দী খাঁয়ের নির্দেশে একবার এই রামচরণ দেবকে যেতে হয়েছিল উড়িষ্যায় বর্গি দমনে। জনশ্রুতি রয়েছে যে এই যাত্রাপথেই রামচরণ দেব দস্যুদের আক্রমণে প্রাণ হারান। অসহায় হয়ে পড়েন রামচরণের বিধবা স্ত্রী। এমনকি হারাতে হয় আশ্রয়। তাঁকে ক্ষতিপূরণ বাবদ আড়পুলীতে কয়েক বিঘা জমি এবং কয়েক হাজার টাকা নগদ দেওয়া হয়েছিল। এরপর রামচরনের বড় ছেলে রামসুন্দর সেই জমি বিক্রি করে সুতানুটির অন্তর্গত শোভাবাজার অঞ্চলে কিছু জমি কিনে একটি বাড়ি তৈরি করেন। আর্থিক অনটন সত্ত্বেও রামচরণ দেবের স্ত্রী তাঁর তিন পুত্রকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলেন। এই রামচরণ দেবের ছোট ছেলে নবকৃষ্ণ দেবকে শোভাবাজার রাজবাড়ির প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে ধরা হয়।
রামচরণ দেবের তিন পুত্রের মধ্যে রামসুন্দর দেব পরবর্তীতে গড় পঞ্চকোটের দেওয়ান হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন। মেজো ছেলে মানিক্য চন্দ্র দিল্লির সম্রাটের কাছ থেকে রায় উপাধিতে ভূষিত হন এবং এক হাজারী মনসবদারের পদ লাভ করেছিলেন। ছোট ছেলে নবকৃষ্ণ দেব আরবী, ফার্সি ও উর্দু ভাষায় পন্ডিত হয়ে ওঠেন।
নবকৃষ্ণ দেব অত্যন্ত বুদ্ধিমান মানুষ ছিলেন। খুব সহজেই রবার্ট ক্লাইভ, ওয়ারেন হেস্টিংস-এর কাছাকাছি এসেছিলেন তিনি। ১৭৫৪ সালে তিনি ওয়ারেন হেস্টিংসের দেওয়ান পদে নিযুক্ত হয়েছিলেন এবং ১৭৬৪ সাল পর্যন্ত ওই পদে বহাল ছিলেন।
আরবি ও ফার্সি ভাষা জানার কারণে খুব তাড়াতাড়ি কর্ম ক্ষেত্রে পদোন্নতি হয়েছিল নবকৃষ্ণ দেবের। পলাশীর যুদ্ধে সিরাজদৌল্লাকে সিংহাসনযুত করার ষড়যন্ত্রের অন্যতম কান্ডারী ছিলেন এই নবকৃষ্ণ দেব। এমনটাই শোনা যায়। কথিত আছে ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে ঔপনিবেশিক শক্তির জয়ের পরই ওই বছরেই নবকৃষ্ণ দেব তার শোভাবাজারের বাসভবনে দুর্গোৎসবের এলাহি আয়োজন করেছিলেন। সেই অনুষ্ঠানে স্বয়ং রবার্ট ক্লাইভ নিমন্ত্রিত ছিলেন এবং আনন্দের সঙ্গে তিনি সেই নিমন্ত্রণ রক্ষা করেছিলেন।
নবকৃষ্ণদেবের পুত্র রাজকৃষ্ণ দেব ও মনসবদার হয়েছিলেন। ব্রিটিশ আমলেই নবকৃষ্ণদেব রাজা উপাধি পেয়েছিলেন। মহারাজা নবকৃষ্ণ দেব ধার্মিক ও বিদ্যানুরাগী ছিলেন। তিনি একটি পন্ডিত সভার পত্তন করেছিলেন শোভাবাজার অঞ্চলে। পন্ডিতের পাশাপাশি বহু গায়ককেও মাসোহারা দেওয়ার ব্যবস্থা করা ছিল। সংগীত চর্চা বিশেষ গুরুত্ব পেত তাঁর আমলে।
শোভাবাজার রাজবাড়ির দুর্গাপুজো আজও ঐতিহ্যের ইতিহাস বহন করে। বর্তমানে শোভাবাজারের দেব পরিবারের দুটি পুজো হয়। বড় তরফ ও ছোট তরফের। দুটি প্রতিমাই একচালা দশভূজা মহিষাসুরমর্দিনীর। পূজোর রীতি এবং উপাচার ও এক। দেবী দুর্গা এখানে বৈষ্ণবী হিসেবে পূজিত হন। পুজোয় অন্ন ভোগ থাকে না। প্রতিদিনই চণ্ডীর আরতি হয়। আগে পশু বলির প্রথা থাকলেও এখন তা বন্ধ। কুমড়ো, আখ, মাগুর মাছের বলি হয়। একসময় কামানের তোপ দাগার মাধ্যমে শুরু হতো শোভাবাজার রাজবাড়ির সন্ধিপুজো। এখন অষ্টমী, নবমীর সন্ধিক্ষণে চিরাচরিত প্রথা মেনে বন্দুকের গুলির শব্দ করা হয়। দশমীর দিন সকালে বিজয়া হয়। বিষাদের সুর বেজে ওঠে তখন। এই রাজবাড়ির প্রতিমা নিরঞ্জনের দৃশ্যটি অপূর্ব। দুটি নৌকার মাঝে প্রতিমা রাখা হয়। মাছ নদীতে পৌঁছলে নৌকা দুটি ধীরে ধীরে সরে যায়, মাতৃ মূর্তি বিসর্জিত হয় জলে। এভাবেই ইতিহাস ও তার ধারাকে বহন করে আসছে শোভাবাজার রাজবাড়ি।
এই রাজবাড়ির ইতিহাস আলো-ছায়ায় ভরা। তবুও এই বাংলার ঐতিহ্যের শিরে এক টুকরো মণির মত অবস্থান করে এই শোভাবাজার রাজবাড়ির ইতিহাস।