এই রাজবাড়ির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে দুটো জেলা। হুগলি আর বর্ধমান। শেওড়াফুলি রাজবাড়ির ইতিহাস বলে, এই রাজবংশের পুত্র দ্বারকানাথ রায় একসময় বর্ধমান জেলার পাটুলি গ্রামে বসবাস করতেন। তাঁর উত্তরসূরি ছিলেন রাঘব রায়। রাঘব রায় তাঁর দুই পুত্র রামেশ্বর ও বাসুদেব-এর মধ্যে সম্পত্তি ভাগ করে দিয়েছিলেন। রামেশ্বর রায় বাঁশবেড়িয়াতে রাজবংশের সূচনা করেছিলেন। পরবর্তীকালে বাসুদেব রায়ের পুত্র মনোহর রায় শেওড়াফুলিতে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। শেওড়াফুলি রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মনোহর রায়কেই ধরা হয়।
শেওড়াফুলি স্টেশন থেকে খানিকটা এগোলেই রাস্তা। নির্মলচন্দ্র ঘোষ সরণি। এই সরণির শেষ প্রান্তে শেওড়াফুলি রাজবাড়ি। রাস্তায় স্মৃতি আর অতীতের আনাগোনা। রাজবাড়ীর আগে রয়েছে একটা মাঠ। মাঠটিকে এখনো রাজগ্রাউন্ড বা রাজবাড়ির মাঠ বলা হয়। মাঠের পিছনদিকে রয়েছে একটি বিশাল পুকুর। এই পুকুরের নাম ‘ঘোড়া ধোয়ানি পুকুর’। ক্ষয়াটে এই পুকুরের ঐতিহ্য এখন ম্লান। আগে রাজপরিবারের ঘোড়াদের স্নান করানো হত এখানে। মাঠের পরেই লোহার প্রবেশদ্বার। প্রবেশদ্বার পেরোলেই সুবিশাল রাজবাড়ি। রাজবাড়ির খানিকটা অংশ এখনও সংরক্ষণ করা হয়। তবে কিছু অংশে জীর্ণভাব স্পষ্ট। প্রয়োজন রক্ষণাবেক্ষণের।
এই রাজবংশের উত্তর পুরুষ গিরীন্দ্রচন্দ্র রায়ের কোন পুত্র সন্তান ছিল না। তাঁর কন্যা নিরুপমা দেবীর একমাত্র পুত্র নির্মলচন্দ্র ঘোষ উত্তরাধিকার সূত্রে জমিদারির অধিকারী হন। রাজবাড়ির প্রবেশদ্বার দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলেই চোখ আটকে যায় ঠাকুরদালানে। সুন্দর কারুকার্য করা। এখানেই প্রতিষ্ঠিত রয়েছেন রাজ পরিবারের কুলো দেবী মা সর্বমঙ্গলা। এই অংশটি রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়। নিত্য পুজো হয় এখানে। মন্দিরের পিছনদিকে রয়েছে একটি সরু গলি। গলিপথে রাজ পরিবারের দৃশ্যকল্পের আনাগোনা যেন। এখানে রয়েছে সুবিস্তিত উঠোন। যদিও এটি রাজবাড়ির বাইরের উঠোন। এখান থেকে আরেকটু এগুলো রাজবাড়ির অন্দরমহলের উঠোন। দুটো উঠোন জুড়েই নিস্তব্ধতা।
উঠোনের পাশে গলিপথ দিয়ে সামান্য এগোলে রয়েছে রাজবাড়ির খিড়কির পুকুর।
বর্তমানে রাজবাড়িটি বেশ কয়েক বিঘা জমির উপর অবস্থিত। বাড়িটির মোট দুটো অংশ। একটি দোতলা ও অন্যটি তিনতলা। ঘরের সংখ্যা প্রায় ২০০ টি। রাজবাড়ির দোতলার কিছু অংশ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে জীর্ণ অবস্থায় রয়েছে। তবে কিছু অংশ সংরক্ষিত। রং করা হয়েছে এখানে।
রাজবাড়ির জানালায় পুরনো আমলের খড়খড়ি লাগানো। সাদা রংয়ের। তবুও সেখানে অতীতের ছাপ স্পষ্ট। এই রাজবাড়ি পূর্ণ সাবেকি আমলের বাসনপত্র ও আসবাবপত্রে।
রাজবাড়ি চত্বরে আরও একটি তিনতলা বাড়ি রয়েছে। যত্নের অভাবে জীর্ণ অবস্থা সেখানে। রাজ পরিবারের সদস্যদের মধ্যে কেউ কেউ এখনও বাস করেন এখানে। রাজবাড়ির রাজারা দয়াশীল, ধৈর্যশীল মানুষ ছিলেন। প্রজাদের সঙ্গে সন্তানসুলভ ব্যবহার করতেন। রাজবাড়িতে নিয়মিত ধ্রুপদ সংগীতের আসর বসত। সেই কারণে রাজবাড়ির মাঝের উঠোনে একটি মঞ্চ তৈরি করা রয়েছে। শোনা যায় নির্মল চন্দ্র ঘোষ মঞ্চটি নির্মাণ করেছিলেন। রাজপরিবারের প্রত্যেক সদস্যই সংগীতানুরাগী ছিলেন। এই রাজবংশের উত্তর পুরুষ সলিলচন্দ্র ঘোষ শেওড়াফুলির বিশিষ্ট সংগীত শিক্ষক হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন।
প্রত্যেক রাজাই নিজেদের ঐতিহ্যকে সম্মান করেছেন। ভালোবেসেছেন প্রজাদের। শেওড়াফুলি অঞ্চলের উন্নতির চেষ্টা করেছেন এই রাজপরিবার। রাজবংশের ইতিহাসে এই রাজ পরিবারের নাম আজও উজ্জ্বল।