এই রাজবাড়ির গড়ে ওঠা পরবর্তীকালে জন্ম দিয়েছিল এক জেলার

পূর্বে মানিকগঞ্জ। পশ্চিমে কুষ্টিয়া। উত্তরে পাবনা। দক্ষিণে ফরিদপুর। মানচিত্রে এই জেলার অবস্থান মোটামুটি এরকম। এই জেলার উত্তরে পদ্মা নদী বয়ে চলে। পশ্চিম থেকে পূর্বে পদ্মা যমুনার সঙ্গমস্থল দৌলতদিয়ার সামান্য উত্তরে আরিচাঘাট। এই জেলা নদীবেষ্টিত। দক্ষিণী পদ্মার শাখা নদী গড়াই নদী, গড়াই এর ওপারে ঝিনাইদহ ও মাগুরা জেলা। এই জেলাকে ঘিরে পদ্মা, চন্দনা, গড়াই, হড়াই, কুমার ও চিত্রা। রাজবাড়ির বর্ণনা না দিয়ে হঠাৎ জেলার কথা হচ্ছে কেন? আসলে ঐতিহাসিকরা বলেন এই জেলার রাজবাড়িকে কেন্দ্র করেই জেলাটির পরিচিতি। তাই রাজবাড়ি এক্ষেত্রে ‌কোন স্থাপত্য বা কোন ভবন নয়, একটি আস্ত জেলা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। বাংলাদেশের রাজবাড়ি জেলা এমনই আশ্চর্য নিদর্শন।

ঐতিহাসিকরা মনে করেন, নিশ্চয়ই কোন একটি রাজবাড়িকে কেন্দ্র করে প্রথমে এই জেলার নাম রাজবাড়ি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিল। তাই সরাসরি রাজবাড়ির স্থাপত্য নিদর্শন না থাকলেও রয়েছে স্নান মঞ্চ, দোল মঞ্চ। অনেকে বলেন এটি আসলে নাটোরের জমিদারির অন্তর্ভুক্ত ছিল। কোনও ঐতিহাসিক বলেন রাজশাহীর জমিদারির অন্তর্ভুক্ত ছিল এই জেলার কিছু অংশ। সঠিকভাবে কোনও একজন রাজা বা নির্দিষ্ট কোন জমিদার ভবনকে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি। তবুও কিছু স্মৃতি, কিছু অতীত রয়ে গেছে স্থাপত্যের আকারে। দর্শনীয় স্থান হিসেবে রয়েছে এই মঞ্চ, নহবতখানা, যার অস্তিত্ব ইঙ্গিত করে অতীতের রাজবাড়ীর অবস্থানকে।

এই জেলা সৃষ্টির ইতিহাস বেশ বৈচিত্র্যময়। এই রাজবাড়ি জেলা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জেলার অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৭৬৫ সালে ইংরেজরা বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানী লাভের পর উত্তর-পশ্চিম ফরিদপুর অঞ্চল রাজশাহীর জমিদারির অংশ ছিল। নাটোরের রাজার জমিদারির চিহ্ন হিসেবে এই রাজবাড়ী জেলার বেলগাছিতে রয়েছে স্নানমঞ্চ, দোলমঞ্চ। এই অংশটি পরবর্তীকালে যশোর জেলার অংশ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল।

১৮১১ সালে ফরিদপুর জেলা সৃষ্টি হলে রাজবাড়িকে এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। ১৮৯৩ সালে সরকার প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে প্রতিটি থানাকে মান উন্নীত থানায় রূপান্তরিত করে। এই রাজবাড়ি অঞ্চল সবসময়ই সমৃদ্ধ হিসেবে পরিচিত ছিল। এই অঞ্চলের খ্যাতি ছিল সারা দেশে। কোনও জমিদার বা রাজাকে এই অঞ্চল নিয়ে কখনই কোন সমস্যায় পড়তে হয়নি। তাই ১৮৯৩ সালের ১৮ জুলাই থেকে সরকার আদেশ জারি করে সকল মান উন্নীত থানাকে উপজেলায় রূপান্তরিত করা হবে। প্রথমবার রাজবাড়ি উপজেলা হিসেবে পরিচিতি পায়। এদিকে গোয়ালন্দ মহকুমার প্রশাসনিক দপ্তর ছিল রাজবাড়ি উপজেলায়। অবশেষে ১৮৯৪ সালের ১ মার্চ সকল মহকুমাকে জেলা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। সেই থেকে রাজবাড়ি রূপান্তরিত হয় জেলায়। ঢাকা বিভাগের অন্তর্গত এই জেলা।

ঐতিহাসিকরা আনুমানিক যে তথ্য দিয়েছেন, তাতে দেখা যায় ১৬৬৬ সালে নবাব শায়েস্তা খান ঢাকায় সুবেদার নিযুক্ত হয়ে এসেছিলেন। এ সময় এই অঞ্চলে পর্তুগিজ জলদস্যদের দমনের জন্য তিনি সংগ্রাম শাহকে নাওয়ারা প্রধান হিসেবে নির্বাচন করে পাঠিয়েছিলেন। তিনি বানিবহতে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেছিলেন এবং লালগোলা নামে এটি স্থানে দুর্গ নির্মাণ করেছিলেন। এই লালগোলা তখন রাজবাড়ি শহরের কয়েক কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত ছিল। সংগ্রাম শাহ ও তার পরিবার পরবর্তীকালে বাণীবহের নাওয়ারা চৌধুরী হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন।

ঐতিহাসিকরা বলেন রাজা সংগ্রাম শাহের রাজদরবার বা রাজকর্মচারীরা ও প্রধান নিয়ন্ত্রণকারী অফিস বর্তমান রাজবাড়ি এলাকাকে কাগজে-কলমে রাজবাড়ি লিখতেন। ১৮৯০ সালে সংগ্রাম শাহের উদ্যোগে রাজবাড়ি রেলস্টেশনটি স্থাপিত হয়েছিল। সংগ্রাম শাহের পরিবারের লোকজন পরবর্তীকালে নাওয়ারা চৌধুরী পরিবার হিসেবে পরিচিত হতে থাকে। স্বদেশীরা এই নাওয়ারা চৌধুরী পরিবারের বাসস্থানকে রাজবাড়ি আখ্যা দিত।

এর একটি অন্য মত পাওয়া যায়। কিছু ঐতিহাসিক বলেন রাজা সূর্য কুমারের নাম অনুসারে রাজবাড়ির নামকরণ হয়েছিল। সূর্য কুমারের পিতামহ প্রভুরাম নবাব সিরাজউদ্দৌলার রাজকর্মচারী থাকাকালীন একবার ইংরেজদের বিরাগভাজন হয়েছিলেন। পলাশীর যুদ্ধের পর তিনি লক্ষ্মীকোলে এসে আত্মগোপন করেছিলেন। পরবর্তীকালে তাঁর পুত্র দ্বিগেন্দ্র প্রসাদ এই অঞ্চলে জমিদারি গড়ে তুলেছিলেন। এই অংশটি পরে রাজবাড়ি জেলার অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। তাই অনেক ঐতিহাসিক মতান্তরে সূর্য কুমারকে রাজবাড়ি জেলার জমিদার বা রাজা হিসেবে আখ্যা দেন। কিন্তু এই নিয়ে কোনও সঠিক তথ্য এখনও পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। যদিও রাজা সূর্যকুমার ও তাঁর পূর্বপুরুষের লক্ষীকোলের বাড়িটি লোকমুখে রাজার বাড়ি বলে বেশি পরিচিত।

মুক্তিযুদ্ধে রাজবাড়ি জেলার অবস্থান ইতিহাসের পাতায় উল্লেখযোগ্য। ১৯৭১ সালের ৯ ডিসেম্বর লক্ষ্মীকোলে এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যুদ্ধ হয়েছিল বিপক্ষ বাহিনীর। মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকজন মারা যায় তাতে। ১৬ ডিসেম্বর প্রায় সারা দেশে পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করলেও রাজবাড়ি শহরে তাঁরা তখনও নিজেদের অধিকার বজায় রেখেছিল। এমনকি এটাও ঘোষণা করা হয়েছিল রাজবাড়ি শহর পাকিস্তানের অধীনে থাকবে। এর পরেই মুক্তিযোদ্ধারা রাজবাড়ি শহরের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে যুদ্ধের জন্য। বিপক্ষ বাহিনীর লোকেরা অবশেষে ১৮ ডিসেম্বর রাজবাড়ির অধিকার ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। অতীত আর স্মৃতি আঁকড়ে এভাবেই রাজবাড়ি জেলা ইতিহাসের পাতায় এক উল্লেখ্য নাম।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...