সময়টা তখন আনুমানিক ষোড়শ শতাব্দী। মুঘল সম্রাট আকবরের সেনাপতি ছিলেন মানসিংহ। মানসিংহের পছন্দের মানুষ ছিলেন বাসুদেব রাম রাই। সেই সময় কৃষক বিদ্রোহ এবং দস্যুদের কারণে জর্জরিত ছিলেন রাজা আকবর। এই বাসুদেব রাম রাই তাঁর বুদ্ধিমত্তা ও সাহসে ভর করে সমাধান করলেন কৃষক বিদ্রোহের সমস্যার। রাজা আকবর অবশেষে মুখ দেখলেন শান্তির। এই বাসুদেব রাম রাইয়ের আদি নিবাস ছিল উত্তরপ্রদেশে। এদিকে তাঁর কাজে খুশি হয়ে মোঘল সম্রাট তাঁকে বাংলায় তিন লাখ একর জমি এবং মণ্ডল উপাধিতে ভূষিত করলেন। জমি পাওয়ার পাওয়ার পর বাংলায় চলে আসেন বাসুদেব রাম। তখন তিনি মণ্ডল উপাধিতে ভূষিত।
তাঁর উত্তরসূরি এবং পরিবারের মানুষেরা বাংলায় এসে জমিদারি প্রথার প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁরা বজবজের বাওয়ালি অঞ্চলে এসে জমিদার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। বাওয়ালিতে ছিল বাওয়াল সম্প্রদায়ের মানুষজনের বসবাস। তখন ওই এলাকা সুন্দরবনের অংশ ছিল। ‘বনে এলি গেলি’ এই শব্দবন্ধ থেকেই নাম হয়েছিল বাওয়ালির। জমিদাররা ছিলেন প্রজা অন্ত-প্রাণ। মুক্ত হস্তে দান করতেন। জমিদারদের নায়েব, গোমস্তারাও প্রজাবৎসল ছিলেন। অবাঙালি হিন্দু এই মণ্ডল পরিবার পরবর্তীকালে পরম বৈষ্ণব হয়ে উঠেছিলেন।
বজবজের বাওয়ালি ছাড়াও দীর্ঘ অঞ্চল সুন্দরবনের অংশ ছিল। মধু সংগ্রহ ছিল তাঁদের প্রধান জীবিকা। পরম বৈষ্ণব মণ্ডল জমিদাররা ধর্মের প্রতি ছিলেন আবেগী। বাওয়ালির এই জমিদাররা তাঁদের কূল দেবতা শ্রী কৃষ্ণের মন্দির স্থাপন করেছিলেন ওই অঞ্চলে। মূলত মন্দির স্থাপনায় তাঁদের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। তাই বাওয়ালিকে একসময় মন্দির নগরীও বলা হত।
১৭৭১ সালে হারাধন মণ্ডল নির্মাণ করেছিলেন বাওয়ালির রাধাকান্ত জিউ-এর মন্দির। ১৭৯৪ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন গোপীনাথ জিউর নবরত্ন মন্দির। এই সব মন্দিরই ইতালিয়ান মার্বেল দিয়ে সাজানো ছিল। বাওয়ালির নাট মন্দির এবং অষ্টভূজাকৃতি রাসমঞ্চ ছিল সেই অঞ্চলের অন্যতম স্থাপত্য।
এছাড়াও তাঁরা নির্মাণ করেছেন দ্বাদশ শিব মন্দির, পোড়ামাটির গোপীনাথ মন্দির, জগন্নাথ দেব লক্ষ্মী জনার্দন, চন্ডীমাতা, রাজরাজেশ্বরী ইত্যাদি দেবদেবীর মন্দির। এই মন্ডল পরিবারের এক অসাধারণ সৃষ্টি ছিল জলটুঙ্গি। বাংলায় সেই সময় এই ধরনের স্থাপত্য ছিল বিরল।
তখনও জমিদারবাড়ি হিসেবেই প্রচলিত ছিল বাওয়ালির মন্ডল পরিবারের রাজবাড়ি । জমিদার'দের সান্ধ্যকালীন বিনোদনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল একটি দিঘির মধ্যে বিশেষ স্থানে। তাকেই বলা হতো চলো জলটুঙ্গি। মণ্ডলদের স্থাপত্যে ছিল ইউরোপীয় ছাপ। তাঁরা নির্মাণ করেছিলেন বিরাট প্রাসাদ।
শোনা যায় বাসুদেব রাম রাইয়ের নাতি শোভারাম দাসমন্ডল উপাধিতে ভূষিত ছিলেন, সেই থেকে তাঁরা দাসমন্ডল পদবী ব্যবহার করতেন। পরে দাস বাদ দিয়ে মন্ডল পদবী ব্যবহার শুরু হয়েছিল। যদিও অনেক ঐতিহাসিক বলেন দাসমন্ডল নয় মন্ডলই ছিল এঁদের আদি পদবী। শোভারাম মন্ডলের নাতি রাজারাম ছিলেন হিজলির রাজার সেনাপতি। তাঁর সাহসিকতা ও বীরত্বে মুগ্ধ হয়ে হিজলির রাজা তাঁকে ৫০টি গ্রাম ও প্রচুর ধনরত্ন দান করেছিলেন।
এই রাজারামের নাতি হারাধন মন্ডল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সুনজরে থাকতেন। প্রকৃতপক্ষে এই সময় থেকেই মন্ডল পরিবারের উন্নতি শুরু হয়। বাওয়ালির জমিদার বাড়ি থেকে রাজবাড়ি হয়ে ওঠার সূচনা হয়েছিল এই হারাধন মন্ডলের হাত ধরেই। হারাধন মন্ডলকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ‘রাজা’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। বাওয়ালির তৎকালীন জমিদার বাড়িকে রুচিশীলভাবে সাজিয়েছিলেন এই হারাধন মন্ডল। হারাধন মন্ডলের সাত পুত্র ছিলেন। বাবার মতই দানশীল ছিলেন তাঁরাও। বাওয়ালি রাজবাড়ি সুনাম বজায় রেখেছিলেন তাঁদের উত্তরসূরিরাও।
বাওয়ালির রাজবাড়ি তে মূলত ইউরোপীয় স্থাপত্যের নিদর্শন মেলে। মোটা দেওয়াল, বড় বড় দরজা-জানলা রাজবাড়ি র অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এই রাজবাড়ি তার রুচিশীলতার পরিচয় দেয় ঝাড়বাতির গঠনে। নানা আকারের ঝাড়বাতি রয়েছে এখানে। কূলদেবতার মন্দির, তুলসী মঞ্চ, নাচ ঘর সবেতেই ইউরোপীয় স্থাপত্য জ্বলজ্বল করছে। সঙ্গে রয়েছে সুন্দর কারুকার্য।
রাজবাড়ির অনেকাংশই সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা মন্দিরগুলোর। তবে কয়েক বছর আগে মন্ডলদের একটা জমিদারবাড়িকে হেরিটেজ রিসর্টে পরিণত করা হয়েছে। পুরনো গন্ধ, খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা, সব মিলিয়ে সপ্তাহান্তের পরিচিত উইকেট স্পট বাওয়ালি রাজবাড়ি।
এই রাজবাড়ির উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল উৎসব। নববর্ষ, বুদ্ধপূর্ণিমা, রথযাত্রা, জন্মাষ্টমী, রাস, ঝুলন পূর্ণিমা সব কিছুতেই সেজে উঠত এই রাজবাড়ি। জমিদাররা সপরিবারে উপস্থিত থাকতেন। বর্তমানে অনেক এমন রকম রঙ হারিয়েছে। আধুনিক ব্যবস্থায় সুসজ্জিত হেরিটেজ রিসর্ট তবে আজও গল্প বলে অতীতের স্মৃতির।