রাজবাড়ি পর্ব ২৩ঃ রাইপুর রাজবাড়ি

সভ্যতায় কত কিছুই তো 'আছে' থেকে 'নেই' হয়ে যায়। ‌ তবুও ইতিহাসের পাতায় কোথাও হয়তো কোন টুকরো রয়ে যায়। কাহিনী হয়ে থেকে যায় কালের স্রোতে। স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে রয়ে যায় কিছু ইট, কাঠ, পাথরের তৈরি কিছু সৌধ।

জঙ্গল দিয়ে ঘেরা। সেই সবুজকে ঘিরে রয়েছে তিনটে নদী। কংসাবতী, ভৈরববাঁকি, তারাফেনি। এমন মনোরম জায়গায় শত্রুর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কয়েকটি দুর্গ তৈরি করেছিলেন রাজারা। বাঁকুড়া-ঝাড়গ্রাম রাজ্য সড়কের এই অঞ্চল জুড়ে এক সময় ছিল রাজবাড়ি। আগে নাম ছিল গড়াইপুর রাজবাড়ি। পরে সময়ের স্রোতে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল প্রায় সমস্ত দুর্গ। গড়াইপুর থেকে বাদ পড়েছিল গড় অর্থাৎ দুর্গ। তাই গড়াইপুর এখন রাইপুর। রাজবাড়ির নামও রাইপুর রাজবাড়ি হিসেবেই পরিচিত।

প্রায় পাঁচশ বছর আগেকার কথা। কাঁসাই নদীর তীরে যে অঞ্চল ছিল তার নাম ছিল শিখরভূম ও তুঙ্গভূম। দক্ষিণ বাঁকুড়ার এই অঞ্চলে নাকি একসময় শিখর ও তুঙ্গ পদবিধারী দুটি রাজ পরিবার রাজত্ব করতেন।

কথিত আছে, মুঘল আমলে চৌহান বংশীয় এক রাজপুত ভাগ্যান্বেষী এই গড় রাইপুরে এসেছিলেন জীবনের খোঁজে। তিনি নাকি ‘শিখর রাজা’ উপাধি নিয়ে এখানে বসতি স্থাপন করেছিলেন। এই পরিবারের শেষ রাজা ছিলেন মিরন শাহ। সশস্ত্র যুদ্ধ বাহিনীর নায়ক ছিলেন এই রাজা। কিন্তু বাৎসল্যে ভরা ছিল তাঁর মন। প্রজাদের সন্তানের মত আগলে রাখতেন।

এই প্রজারা যুদ্ধের সময় রাজার জন্য প্রাণপণে লড়াই করার চেষ্টা করেছিলেন। তবুও বাঁচাতে পারেনি রাজাকে। সেই সময়ে বাংলায় তখন মারাঠাদের আক্রমণ চলছিল। যথারীতি প্রভাব পড়েছিল গড়াইপুরে।

‌প্রজারা প্রাণপণে বাঁচানোর চেষ্টা করলেও এই যুদ্ধে মারা যান শিখর রাজা মিরন শাহ। শিখর রাজা মারা গিয়েছিলেন কম বয়সেই। সেই সময় রাজা মারা যাওয়ার পর প্রবল ভীতি তৈরি হয়েছিল প্রজাদের মনে। নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিলেন তাঁরা। মারাঠারাও বারবার আক্রমণ করছিল এই অঞ্চলে। সেই সময় শিখর রাজবংশের রাজপুরোহিত রাজদণ্ড হাতে নিয়ে ক্ষমতা দখল করেন। কিন্তু প্রজারা তাঁর কাজকর্মে সন্তুষ্ট ছিলেন না। তাঁর রাজত্ব ছিল ক্ষণস্থায়ী। কিছুদিনের মধ্যেই মল্ল রাজা কৃষ্ণ সিংহের ছোট ভাই ফতে সিংহ বরাভূম রাজার সাহায্যে রাজ পুরোহিতের হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে রাইপুরে বসবাস শুরু করেছিলেন। ফতে সিংহ মুর্শিদাবাদ মুর্শিদাবাদের নবাবের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে রাজ পরিবারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং নিজের রাজত্ব চালাতে শুরু করেন।

কিন্তু তিনিও রাজত্ব চালাতে সফল হননি সেইভাবে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে রাইপুরের জমিদার পরিবার অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়েছিল। গিসবন কোম্পানি তখন এই জমিদারির দায়িত্ব নেয়। ১৮০৫ সালে জঙ্গলমহল জেলা গঠিত হয়। যদিও পরে ১৮৩২ সালে অবলুপ্ত হয় এই জেলা। ১৮৫৭ সালে রাইপুর প্রথমে মানভূম জেলার অন্তর্গত ছিল। পরে বাঁকুড়া জেলায় স্থানান্তরিত করা হয় এই অঞ্চলকে।

গড় রাইপুর বা গড়াইপুর সহ ২৭টি মৌজা নিয়ে গঠিত হয়েছিল ফতে সিংহের বংশধর রাজা দুর্জন সিংহের জমিদারি। চুয়াড় বিদ্রোহের সময় গ্রেপ্তার হয়েছিল দুর্জন সিংহ। ১৭৯৯ সালের ২০ নভেম্বর ব্রিটিশ সরকার দুর্জন সিংহকে নির্দিষ্ট অংকের ক্ষতিপূরণের বিনিময়ে মুক্তি দেয়। কিন্তু জমিদারি ফিরিয়ে দেওয়া হয়নি। এরপর ঋণের দায়ে জর্জরিত হয়ে পড়েছিল এই রাইপুর। দ্বারভাঙ্গা রাজার অধীনে চলে যায় এই গড় রাইপুর বা গড়াইপুর।

অনেক ঐতিহাসিক এই গড় রাইপুর বা গড়াইপুর তত্ত্বে বিশ্বাস করেন না। তাঁদের মতে রাইপুরের প্রাচীন নাম ছিল সম্ভবত ধরমপুর। পরে রাজাদের কুলদেবতা রাইয়ের নাম অনুসারেই নাকি এই জনপদের নাম রায়পুর হয়েছে।

তবে এই অঞ্চলের সঙ্গে গড় অর্থাৎ দুর্গের সম্পর্ক স্বীকার করে নিয়েছেন ওই অঞ্চলের প্রবীণ মানুষরাও। রায়পুরের অধিষ্ঠাত্রী দেবী নাকি কোকামুখা দেবী। রাইপুরে এখনও রয়েছে ভগ্নপ্রায় রাজবাড়ি। এছাড়াও পুরনো দিনের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে রয়েছে মন্দির।

অতীত যত আধুনিকতার পথে এগিয়েছে বদলে গেছে রাইপুর। তবে ভগ্নপ্রায় রাজবাড়ি, জগন্নাথ ও হনুমানজীর মন্দির এই অঞ্চলের সংস্কৃতির পরিচয় বহন করছে। শোনা যায় রাইপুর একসময় স্বাধীনতা আন্দোলনের কেন্দ্র ছিল। বিপ্লবীদের বহু অভিযানের গোপন ঘাঁটি ছিল এই রাইপুর।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...