এক সিদ্ধ-পুরুষের সাহায্যে জীবন বদলে যায় এই রাজ পরিবারের প্রতিষ্ঠাতাদের

বাংলা সে সময় বর্গীদের আক্রমণে বিপর্যস্ত। রামশংকর এবং কুবেরশংকর নন্দী হালিশহরের অন্তর্গত কেউটে গ্রাম থেকে সপরিবার জামগ্রামে আশ্রয় নেন। কারণ বারবার বর্গিদের আক্রমণে বিপর্যস্ত চারিদিক। তাই বিপদ থেকে বাঁচার জন্য তাঁরা জামগ্রামে চলে আসেন। ভিটেমাটিহীন এই দুই যুবকের তখন কর্পুদকশূন্য অবস্থা। গ্রাসাচ্ছাদনের জন্যে লড়াই করতে হচ্ছে রীতিমত। এমনকি পানীয় জলকষ্ট ভোগ করেছেন তাঁরা। একদিন দুই ভাই পাশের গ্রামের একটি পুকুরে জলপান করতে এসেছিলেন। সেখানেই দেখা হয় এক ফকিরবাবার সঙ্গে। সেই গ্রামে ওই ফকিরবাবা হাপুজী নামে পরিচিত ছিলেন। কথিত আছে তাঁর আশীর্বাদে নাকি সোনা ফলত।

এই দুই ভাইয়ের হাতে একটি সোনার মোহর দিয়ে ফকিরবাবা তাঁদের আশীর্বাদ করেছিলেন। এই দুই ভাইকে তাঁদের সৌভাগ্য সম্পর্কে সুনিশ্চিত করেছিলেন এই সিদ্ধ যোগীপুরুষ। ফকির বাবার কথামতোই কলকাতার পোস্তায় সুপুরি ও পরে তার সঙ্গে গরম মশলা ও নুনের ব্যবসা শুরু করেছিলেন রামশংকর নন্দী ও কুবেরশংকর নন্দী। কিছুদিনের মধ্যেই সেই ব্যবসা ফুলে ফেঁপে  ওঠে। ব্যবসার অগ্রগতির ফলে দুই ভাই ব্যবসা আরো বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তাঁরা কলকাতার মানিকতলায় এবং বর্ধমানের কালনায় বিস্তার করেন তাঁদের ব্যবসা। আশাতীত উপার্জন হতে থাকে । দুই ভাইয়ের মনে তখন ফকিরবাবার প্রতি গভীর বিশ্বাস ও কৃতজ্ঞতা। কিন্তু নিজের গ্রামকে ভুলে যায়নি এই দুই ভাই। ব্যবসার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা গ্রামের উন্নতির কথাও চিন্তা করতে থাকেন। কয়েক বছরের মধ্যেই জামগ্রামে গড়ে তোলেন বিশাল রাজবাড়ি। প্রায় ১৩ বিঘা জমির উপর তৈরি করা হয়েছিল এই রাজবাড়ি। এই জামগ্রামেরই পরবর্তীকালে নাম হয় পান্ডুয়া। হাওড়া থেকে মেইনলাইন ট্রেনে ৭২ কিলোমিটার দূরত্ব। বর্ধমান থেকেও আসা যায় এখানে। ব্যান্ডেল থেকেও খুব একটা দূরে নয় এই পান্ডুয়া। স্টেশনে নেমে অটো বা টোটোতে নন্দীবাড়ি বললেই খুব সহজেই পৌঁছে যাওয়া যায় এক টুকরো ইতিহাসভ্রমণে।

রাজবাড়ির আগেই কৃষ্ণমন্দির। মন্দিরের পাশেই স্মৃতিমাখানো রাজবাড়ির দরজা। রাজবাড়ির দরজা পেরোলেই দুর্গাদালান আর তার বাঁদিকে দুর্গা মণ্ডপ। আড়াইশো বছর ধরে এই রাজবাড়ীতে দুর্গাপুজো অনুষ্ঠিত হয়। নন্দী পরিবারের মানুষরা আয়োজন করে থাকে এই পুজোর। পুজোর কয়েকদিন গ্রামবাসীদের সঙ্গে আনন্দে মেতে ওঠেন সকলেই।

এই পরিবারে দুর্গাপুজোর শেষ হয় কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর পরের দিন। লক্ষ্মীপুজোর দিন ফকিরবাবার সমাধিস্থলে জমায়েত হয়ে স্মরণ করা হয় ওঁকে। তাঁকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্যে সিন্নি, প্রসাদ নিবেদন করা হয়।

রাজ পরিবারের পুরনো ধানের গোলা এখন রাজবাড়ির ভোগঘর। পুজোর কয়েকটা দিন ভোগ রান্না হয় এখানে। দুর্গাপুজোর দিন সকলে একসঙ্গে এখানে বসে ভোগ গ্রহণ করেন। এরপরেই জমিদারের বৈঠকখানা। এই বৈঠকখানায় পুরনো আসবাব পত্র সযত্নে রাখা রয়েছে এখনো। এই পরিবারে প্রায় সকল পুরনো জিনিস সংরক্ষণ করে রাখা রয়েছে। রাজবাড়ির ভাঁড়ার ঘর আজও বহন করে চলেছে অতীতের জৌলুসময় দিনের স্মৃতি। পুরনো দামি বাসনপত্র সারি সারি সাজিয়ে রাখা রয়েছে।

নন্দী পরিবারের কুলদেবতা শ্রী লক্ষ্মীজনার্দন। এখনো দুবেলা নিয়মিত পুজো হয় এখানে। রাসমঞ্চ ও রাসমন্দির রয়েছে রাজবাড়ি সংলগ্ন বিস্তৃত এলাকায়। দোলযাত্রা, জন্মাষ্টমী, রাধাষ্টমী, উৎসব পালন করা হয় এখানে।

নানা জনশ্রুতি প্রচলিত রয়েছে এই রাজবাড়ি ঘিরে। শোনা যায় একবার বাংলার তৎকালীন বড়লাট ওয়ারেন হেস্টিংসের টাকার দরকার পড়েছিল। তিনি এই রাজ পরিবারের থেকে টাকা দাবি করেন। এদিকে ইংরেজদের তখন রানি ভবানীর সঙ্গে বিরোধ চলছিল। বড়লাট হেসটিংস রানি ভবানীর তিনটি মহল এই নন্দী পরিবারকে অনেকটা দামে কিনে নিতে বলেছিলেন। নন্দীরা অনিচ্ছা সত্ত্বেও ইংরেজদের দাবি মানতে বাধ্য হন। তবে ইংরেজদের কাছে কখনোই নিজেদের সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করেননি এই নন্দী পরিবার। প্রজাদের স্বার্থ দেখেছেন বারবার।

১৮৮০ সালে নন্দীবাড়ির জমি-জমা কুলদেবতা লক্ষ্মীজনার্দনের নামে রেজিস্ট্রি করা হয়েছিল। ১৮৯৯ সালে সমস্ত ব্যবসা অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই রাজ পরিবারের সমস্ত কিছুই দেখাশোনা করে ট্রাস্ট। তবে পরিবেশের উত্তরপুরুষরা অনেকেই বাইরে থাকেন এবং সুপরিকল্পিতভাবে রাজবাড়ি ব্যবস্থাপনার খেয়াল রাখেন। হুগলির পান্ডুয়ার রাজবাড়ী এভাবেই বহন করে চলেছে স্মৃতিময় অতীত।

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...