রাজবাড়ি পর্ব ১৫ঃ পঁচেটগড় রাজবাড়ি

পূর্ব মেদিনীপুরের পটাশপুর ব্লক। গ্রাম জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে টুকরো টুকরো ইতিহাস। মেদিনীপুর ইতিহাসের সম্ভার। পুরনো দিনের গন্ধ মাখা গ্রাম পঁচেটগড়। মন্দিরময় গ্রাম। চারদিকে ইতিহাসের হাতছানি।

এই অঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত রয়েছে প্রায় ৩৫০ থেকে ৪০০ বছরের ইতিহাসের নিদর্শন। উড়িষ্যার বাসিন্দা ছিলেন মুরারীমোহন দাস মহাপাত্র। তখন মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেব ছিলেন মসনদে। সম্রাট খুব খুশি ছিলেন মুরালি মোহন দাস মহাপাত্রের কাজে। খুশি হয়ে তিনি একবার পঞ্চগড় বা পঁচেটগড় ও তার সংলগ্ন বিস্তৃত এলাকার জায়গীর প্রদান করেন মুরারীমোহন দাস মহাপাত্রকে।

 

Panchetgarh1

 

তবে শুরুর আগে রয়েছে আরও ইতিহাস। মুরারীমোহন দাস মহাপাত্র উড়িষ্যার জগন্নাথ দেবের সামনে রোজ সংগীত পরিবেশন করতেন। সেই সময় রাজা মুগ্ধ হয়ে তাঁকে মন্দির পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। ঔরঙ্গজেবের কাছ থেকে জায়গীর পাওয়ার আগে সম্রাট জাহাঙ্গীর ও তাঁকে বাংলা, বিহার ও তাম্রলিপ্ত বন্দর পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। জাহাঙ্গীর-এর মূল লক্ষ্য ছিল যেভাবেই হোক তাঁর সাম্রাজ্যে কোন বিদ্রোহ যেন না ঘটে। ‌অত্যন্ত সুচতুরভাবে এই কাজটি সম্পন্ন করতেন মুরারী মোহন দাস মহাপাত্র। জাহাঙ্গীর ও ঔরঙ্গজেবের আনুকূল্যে পূর্ব মেদিনীপুরের পটাশপুর এলাকায় বিশাল গড় বা দুর্গ নির্মাণ করেন মুরারী মোহন দাস মহাপাত্র। যদিও এই দুর্গ থেকেই পরবর্তীকালে রাজবাড়ি তৈরী হয়েছিল কি না সে নিয়ে রয়েছে যথেষ্ট সন্দেহ।

শোনা যায় এই অঞ্চলে পরবর্তী সময়ে উদ্ধার হয়েছিল শিবলিঙ্গের। এমনকি পরবর্তীকালে এই অঞ্চল থেকে আরও শিবলিঙ্গ উদ্ধার হয়েছিল। মোট পাঁচটি শিবলিঙ্গের পুজো করা হত। সেখান থেকেই পঞ্চেশ্বর নাম হয়েছিল ওই অঞ্চলের। ধীরে ধীরে পঞ্চেশ্বর নামটি প্রচার হতে থাকে। এই পঞ্চেশ্বর থেকেই বর্তমান পঁচেটগড় নাম হয়।

 

Panchetgarh2

 

পরবর্তীকালে ওই অঞ্চলে জমিদারি শুরু করেন মুরারীমোহন দাস মহাপাত্র। শ্রীচৈতন্যদেব যখন পটাশপুর হয়ে পুরী পৌঁছেছিলেন, সেই সময় তাঁর সান্নিধ্যে আসেন মহাপাত্র পরিবার। তখন তাঁরা বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হন। পরে এই জমিদার বাড়ির কূলদেবতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন কিশোর রাই জিউ। পরবর্তীকালে মুরারী মোহন দাস মহাপাত্রের বংশধরদের রাজা উপাধি দেওয়া হয়েছিল।

এই কিশোর রাই জিউকে কেন্দ্র করে শুরু হয়েছিল রাস পূর্ণিমার উৎসব। মুরারী মোহন দাস পাত্রের হাত ধরেই পত্তন হয়েছিল পঁচেটগড় রাজবাড়ির। যদিও জমিদারী ছিল তাঁর মূল পেশা, কিন্তু বৈভব ও নিষ্ঠাবান হওয়ার জন্যে ওই অঞ্চলে তাঁকে রাজা বলা হত।

 

Panchetgarh3

 

এই রাজবাড়ি অন্যতম ঐতিহ্য কিশোর রাই জিউ দেবতার উপাসনা ও রাস উৎসব। এই রাজবাড়িতে এখনো জাঁকজমকপূর্ণ রাস উৎসব পালন হয়। ধর্ম, সংস্কৃতি ও সামাজিক ঐক্যের অন্যতম মিলনক্ষেত্র হয়ে ওঠে এই রাজবাড়ি। রাস উৎসবে প্রতি সন্ধ্যায় কুড়িজন মহাপ্রভু বিগ্রহ মঞ্চে থাকেন। তবে মূল উৎসব শেষে তাঁরা ফিরে আসেন মন্দিরে।

এই রাজবাড়ির সঙ্গে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের নিবিড় যোগাযোগ রয়েছে। বিষ্ণুপুরের রাজার কাছ থেকে এই রাজ দরবারে আসেন শাস্ত্রীয় সংগীত বিশেষজ্ঞ যদু ভট্ট। এই বাড়ির এক সদস্য যাদবেন্দ্র ছিলেন সেই সময়ের ভারতবর্ষের বিশিষ্ট সেতার বাদক। বর্তমানে তাঁর ব্যবহৃত একটি বাদ্যযন্ত্র ভারতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে।

 

Panchetgarh4

 

এই মহাপাত্ররা ক্ষত্রিয়। পরবর্তীকালে তাঁরা বৈষ্ণব হয়েছিলেন। যুদ্ধবিদ্যা তাঁদের নখদর্পণে ছিল একসময়। কিন্তু বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণ করার পরে তাঁরা মন দিয়েছিলেন সংগীত ও নাট্যচর্চায়। শাস্ত্রীয় সংগীত, লোকসঙ্গীতের চর্চা করতেন এই রাজবাড়ির রাজারা। মুরারী মোহন দাস মহাপাত্রের পঞ্চম বংশধর ফাল্গুনী দাস মহাপাত্র বর্তমানে দেখাশোনা করেন এই রাজবাড়ির।

ঐতিহ্য ও স্মৃতি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য এই রাজবাড়ির কিছু অংশ পর্যটকদের জন্য হোমস্টে হিসেবে ভাড়া দেওয়া হচ্ছে। তবে সে ভাবে পরিচিত হয়নি এখনও। মুঘল সম্রাটের বিশ্বস্ত কর্মচারীর পরিসর থেকে মন্দিরময় রাজবাড়ি হয়ে ওঠার সুদীর্ঘ পথ পেরিয়েছে এই পঁচেটগড় রাজবাড়ি।রাজবাড়ির আনাচ-কানাচ জুড়ে সেই সাক্ষ্য বর্তমান।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...