রাজবাড়ি পর্ব ১১ঃ পাইকপাড়া রাজবাড়ি

বেলগাছিয়াউত্তর কলকাতা। রাস্তার সোঁদা গন্ধ। পুরনোদের গন্ধে মাখামাখি উত্তর কলকাতার এই অঞ্চল। বেলগাছিয়া মিল্ক কলোনির ভেতর দিয়ে একটু হেঁটে গেলেই চোখে পড়বে স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার শাখা। সেটিকে বাম দিকে রেখে গলিপথে হাঁটলে লাল রঙের ভগ্নপ্রায় একটা ভিলা। বেলগাছিয়া ভিলা। বেলগাছিয়া রাজবাড়ি বা পাইকপাড়া রাজবাড়ি নামেও পরিচিত এই ভিলা। আগাছারা স্মৃতির মতো জড়িয়ে ধরেছে পাইকপাড়া রাজবাড়িকে। ইতালিয়ান স্থাপত্যে নির্মিত এই রাজবাড়ি।

ব্রিটিশরা তখন একটু একটু করে ভারতের স্থাপত্যে আকৃষ্ট হচ্ছে। বেলগাছিয়া ভিলা হঠাৎ করেই চোখে পড়ে এক ইতালিয়ান ব্যবসায়ীর। নাম অকল্যান্ড। নিজের মত করে সাজিয়ে গুছিয়ে তিনি ভিলাটি রেখেছিলেন। এই ভিলা হঠাৎ চোখে পড়ে প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের। এক দেখাতেই পছন্দ হয়ে যায় সুন্দর বাড়িটি। বেলগাছিয়া ভিলা তখনও পর্যন্ত পাইকপাড়া রাজবাড়ি হয়ে ওঠেনি।

 

Paikpara1

১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর অকল্যান্ডের থেকে কিনে নেন ভিলাটি। রুচিশীল প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর ইংল্যান্ড থেকে একজন স্থপতি ও প্রযুক্তিবিদ এনে সংস্কার করেন বাড়িটির। সম্পূর্ণ ভিলাকে সাজিয়ে তোলেন ইউরোপীয় স্থাপত্যে। দ্বিতল এই বেলগাছিয়া ভিলা তখন ইউরোপিয়ান স্থাপত্যের অন্যতম নিদর্শন হয়ে উঠেছিল। তখনকার সময়ে দু'লক্ষ টাকা খরচ করে এই ভিলা সাজিয়েছিলেন প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর। ঘরের সংখ্যা ছিল মোট ৫৪টি। ইংল্যান্ড এবং ইতালি থেকে আসবাবপত্র এনে সাজিয়ে তুলেছিলেন বেলগাছিয়া ভিলা।

এই ভিলার প্রবেশপথে সিকান্দর আলেকজান্ডারের মার্বেল পাথরের মূর্তি স্থাপন করান তিনি। আমোদ-প্রমোদের সবরকম ব্যবস্থা রেখেছিলেন। শোনা যায় এই ভিলার সিঁড়ির ডিজাইন বাকিংহাম প্যালেসের ডিজাইনের মত। রীতিমতো বিস্ময় ছিল সে যুগে।

 

Paikpara2

 

এই ভিলায় চলত বিশেষ অনুষ্ঠান। ইংরেজদের যাতায়াত ছিল অবাধ। আড়ম্বরপূর্ণ এই ভিলায় সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত মানুষের যাতায়াত লেগে থাকত রোজ। প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর এই ভিলার পাশেই স্ত্রীর জন্য গড়ে তুলেছিলেন একটি আলাদা বাড়ি। পৃথক মহল হিসেবে। স্থানীয় লোকেরা এটিকে রানীমহল বলেন। এই রানীমহলের সঙ্গে যুক্ত আছে একটি পুকুর।

প্রতীক্ষালয়, বাগানবাড়ি, ঝুলন্ত সেতু মিলিয়ে রীতিমত রাজকীয় ব্যবস্থা ছিল সবকিছুর। কিন্তু সময় বোধহয় সবকিছুকেই গন্ডিতে বেঁধে দেয়। নির্দিষ্ট করে দেয় তার আয়ুষ্কাল। ১৮৪৬ সালে ইংল্যান্ডে মারা যান প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর। জানা যায় তিনি ঋণে জর্জরিত ছিলেন সেই সময়। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর বেলগাছিয়া ভিলাসহ আরও সম্পত্তি বিক্রি করতে বাধ্য হন।

 

Paikpara3

 

লক্ষ লক্ষ টাকায় সেজে ওঠা বাড়ি মাত্র কয়েক হাজার টাকার বিনিময়ে বিক্রি হয়ে গিয়েছিল মুর্শিদাবাদ জেলার কান্দি মহকুমার বিত্তশালী সিংদের কাছে। তখন ১৮৫৬ সাল। তিন বছর পরে এই ভিলা অবশেষে পাইকপাড়ার রাজা প্রতাপ চন্দ্র সিং রায় বাহাদুর কিনে নেন। তখন থেকেই বেলগাছিয়া ভিলা হয়ে ওঠে পাইকপাড়া রাজবাড়ি। যেহেতু এটি বেলগাছিয়া অঞ্চলে অবস্থিত তাই অনেকে বেলগাছিয়া রাজবাড়িও বলে থাকেন।

ততদিনে কলকাতার সংস্কৃতির সঙ্গে নাম জুড়ে গেছে পাইকপাড়া রাজবাড়ীর। পাইকপাড়া রাজবাড়ীর রাজা যত্ন করে রক্ষা করেছিলেন এই সংস্কৃতির ঐতিহ্য। নিয়মিত নাচ গানের অনুষ্ঠান হতো এখানে। বাংলা থিয়েটারের অনেক দিকপাল শিল্পীরা আসতেন। আমন্ত্রিত হতেন ইউরোপীয়রাও। রাজা প্রতাপ চন্দ্র সিং এবং ঈশ্বর চন্দ্র সিং বেলগাছিয়া নাট্যমঞ্চ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পন্ডিত রাম নারায়ণ-এর বিখ্যাত নাটক 'রত্নাবলী' প্রথমবার অনুষ্ঠিত হয়েছিল বেলগাছিয়ার বাগানবাড়িতে।

 

Paikpara4

 

সেই নাটক দেখে ইউরোপীয় অতিথিরা এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে এর ইংরেজি অনুবাদ মাইকেল মধুসূদন দত্তের নির্দেশনায় পরিচালিত হয়।মাইকেল মধুসূদন দত্তের শর্মিষ্ঠা নাটকও অভিনীত হয়েছিল এখানে। নাটকের অনুবাদের সূচনা হয় এই রাজবাড়ির অনুষ্ঠান ঘিরে। বাংলার থিয়েটারের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল এই বেলগাছিয়া রাজবাড়ী। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিক থেকে বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে পর্যন্ত পাইকপাড়া রাজবাড়ি ছিল বাংলা থিয়েটারের বহু নাটকের আঁতুড়ঘর।

শুধু নাটক নয়, সঙ্গীত সংক্রান্ত অনেক মজার ঘটনাও জড়িয়ে রয়েছে এই পাইকপাড়া রাজবাড়ির সঙ্গে। শোনা যায় এই রাজবাড়ির রাজা ইন্দ্র চন্দ্র সিংহের কানে নাকি কিছু সমস্যা ছিল। নিয়মিত কান পরিষ্কার করতে হত তাঁকে। এই কাজের জন্য দক্ষ পরামানিক নিয়োগ করা হয়েছিল। এদিকে যতক্ষণ তাঁর কান পরিষ্কার হয়, খুব বিরক্ত হতেন ইন্দ্র চন্দ্র সিংহ। কারণ সেই সময়টায় কিছুই করার থাকত না বসে থাকা ছাড়া। এক অদ্ভুত খেয়াল মাথায় এল রাজার।

 

Paikpara5

 

এমন কোন দক্ষ ব্যক্তি নিয়োগ করা হবে তাঁর কান পরিষ্কারের জন্য, যে নাকি কান খুশকি অর্থাৎ কান পরিষ্কার করার উপকরণটি দিয়ে কোন রাগ রাগিনী বাজাতে পারবে। পাওয়া গেল তেমন কারিগর। এমনকি রাজার এই খেয়ালের সম্মান রক্ষা করতে অনেক কারিগর শিখেও নিল এমন বিদ্যা। শোনা যায় রাজার আবদার মেটাতে রাগরাগিণীর গৎ ছাড়াও বন্দেমাতরম বাজিয়ও শুনিয়েছিলেন একজন কারিগর। পূর্ণেন্দু পত্রীর 'ছড়ায় মোড়া কলকাতা' বইয়ে পাওয়া যায় এমন সব কথা মজার কথা। পরে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হয়ে গেলে রাজবাড়িআর তেমনভাবে রক্ষা করতে পারেননি পরবর্তী উত্তরসূরিরা। রাজবাড়ি হারিয়ে ফেলেছে তার পুরনো গৌরব। স্মৃতিরা শুধুই আগাছা ভরা দেওয়াল জুড়ে থেকেছে।  রক্ষণাবেক্ষনের অভাবে শুধুই স্মৃতি হয়ে রয়ে গিয়েছে এই রাজবাড়ি।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...