নাটোরের উন্নতির নেপথ্যে ছিলেন এই রাজবাড়ির রানি

মোঘলদের শাসনকালে রাজশাহীর পুঠিয়ার রাজা নারায়ণের লস্করপুর পরগণার বারইহাটি গ্রামের তহশীলদার ছিলেন কামদেব। এই কামদেবের দুই পুত্র রামজীবন ও রঘুনন্দন পড়াশোনায় ছিলেন মেধাবী। রঘুনন্দন অত্যন্ত বুদ্ধিমান ছিলেন। খুব কম বয়সেই লেখা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তৎকালীন রাষ্ট্রীয় ভাষা পারসিতে বিশেষ দক্ষতা লাভ করেছিলেন। রাজা দর্পনারায়ণের সহযোগিতায় নবাব মুর্শিদকুলি খাঁর অধীনে তিনি চাকরিও পেয়েছিলেন কম বয়সেই। নবাবের দেওয়ান নিযুক্ত হয়েছিলেন তিনি। ভাইকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন রঘুনন্দন। যে সমস্ত জমিদারেরা সঠিক সময় খাজনা দিতে পারতেন না তাঁদের জমি নিলামে কিনে নিয়ে ভাইয়ের নামে বন্দোবস্ত করে নিয়েছিলেন। ১৭০৬ সালে এভাবেই বিখ্যাত জমিদার গণেশরাম রায় ও ভগবতী চরণ চৌধুরী রাজস্ব দিতে পারেননি বলে তাঁদের জমিদারি কিনে নিয়েছিলেন রঘুনন্দন। তবে কিনেছিলেন ভাই রামজীবনের নামে।

ভাতছাড়া নামে একটি বিশেষ বিল প্রণয়ন করে রঘুনন্দন ও রামজীবন তাঁদের জমিদারী স্থাপন করেন আলাদা করে। রাজা দর্পনারায়ন এই দুই ভাইকে একটি জমি ব্রহ্মোত্তর দান করেন। রামজীবন সেই জায়গা বসবাসের উপযুক্ত করে তুলেছিলেন। নাম দিয়েছিলেন নাট্যপুর। গড়ে তুলেছিলেন রাজবাড়ি। প্রায় চার থেকে পাঁচ বছর ধরে নির্মিত হয়েছিল এই রাজবাড়ি। এই নাট্যপুর পরবর্তীতে পরিচিত হয় নাটোর নামে। খুব অল্প দিনেই সমস্ত সুযোগ সুবিধাসমেত নাটোর একটি শহর হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিল।

Natore Rajbari (1)

রাজা রামজীবন এই রাজবাড়ির প্রথম রাজা ও প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ১৭০৬ সাল থেকে ১৭৩০ পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন। তাঁর একমাত্র পুত্রের অকালমৃত্যু হলে তিনি রামকান্তকে দত্তক নিয়েছিলেন। এই রামকান্তের সঙ্গেই বিয়ে হয়েছিল রানি ভবানীর। ১৭৩০ সালে মারা গিয়েছিলেন রাজা রামজীবন। রাজা রামজীবনের দত্তকপুত্র রামকান্ত ছিলেন ক্ষণজন্মা। ১৭৪৮ সালে মারা যান রাজা রামকান্ত। রানি ভবানী বুদ্ধিমতী ও বিচক্ষণ নারী ছিলেন। নবাব আলীবর্দী খাঁ রানিকে জমিদারি পরিচালনার দায়িত্ব দেন রাজার মৃত্যুর পর।

রানি ভবানীর রাজত্বকালে জমিদারি বিস্তার লাভ করে। রানি প্রজাবৎসল ছিলেন। প্রজাদের সমস্ত সুবিধা-অসুবিধার দিকে নজর রাখতেন। তাঁর রাজত্বকালে নাটোর পেরিয়ে রাজশাহী, পাবনা, বগুড়া, কুষ্টিয়া, যশোর, রংপুর এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, মালদহ পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছিল নাটোর রাজ্য। রানি ভবানীকে বলা হযত অর্ধবঙ্গেশ্বরী। তাঁর আমলে বিস্তৃত রাজ্যের পরিমাপ ছিল প্রায় বারো হাজার বর্গমাইল।

রানি ভবানী শিক্ষা, চিকিৎসা, পানীয় জলের ব্যবস্থা, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, প্রত্যেকটি বিষয়ে নজর রাখতেন। প্রজারা সম্মান করে তাঁকে মহারানী ডাকতেন। ইংরেজ লেখক হলওয়েলের তথ্য অনুযায়ী রানি ভবানীর জমিদারীর বার্ষিক খাজনা ছিল সে যুগের হিসেবে প্রায় সাত লক্ষ টাকা এবং বার্ষিক অর্জিত রাজস্ব ছিল প্রায় পনেরো লক্ষ টাকা।
এই রানি মা ছিলেন দেশ-সাধিকা। তিনি পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজ-উদ-দৌল্লাকে সমর্থন করেছিলেন। এমনকি নিজের সৈন্যবাহিনী পাঠিয়েছিলেন সিরাজদৌল্লার হয়ে লড়াই করার জন্য।

১৮০২ সালের ৫ই সেপ্টেম্বর মারা যান রানি। তারপর রাজ্যভার গ্রহণ করেছিলেন তাঁর দত্তকপুত্র রামকৃষ্ণ। রামকৃষ্ণের মৃত্যুর পর রাজবাড়ি বড় তরফ ও ছোট তরফে বিভক্ত হয়ে যায়। রামকৃষ্ণের দুই সন্তান বিশ্বনাথ ও শিবনাথ।

রানি ভবানীর স্মৃতিবিজড়িত মূল ভবনটি নাটোর রাজবাড়ি হিসেবে পরিচিত। এটি বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অধীনে রয়েছে। আয়তন প্রায় একশ কুড়ি একর। বিশাল এলাকাজুড়ে কারুকার্যখচিত ছোট-বড় আটটি ভবন রয়েছে। প্রত্যেকটি ভবনের সঙ্গেই সিঁড়ি রয়েছে। এছাড়াও অনেকগুলি পুকুর আছে। এই রাজবাড়িতে আছে দুই স্তরের বেড়চৌকি। বাইরের শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে এগুলি তৈরি করা হয়েছিল। এছাড়াও রয়েছে আটটি শিব মন্দির। এই মন্দিরগুলোর দেওয়াল জুড়ে টেরাকোটার শিল্পকর্ম শোভা পায়। এই রাজবাড়ি রক্ষণাবেক্ষণ করে বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ। তাই সমগ্র রাজবাড়ির বেশিরভাগ অংশই সুন্দরভাবে সজ্জিত। রাজবাড়ির প্রাঙ্গণে নানান গাছ রয়েছে। তবে অতিথিশালার অবস্থা প্রায় ভাঙাচোরা। রানি ভবানীর পরবর্তী বংশধরদের মধ্যে রাজা জগদিন্দ্রনাথ উল্লেখযোগ্য। কিন্তু তার পরের প্রজন্মের বংশধরেরা বেশিরভাগই কলকাতায় বসবাস করতেন। তাই রাজবংশের সমাপ্তি ঘটে এক সময়।

১৯৮৬ সাল থেকে রাজবাড়ির পুরো এলাকাটি রানী ভবানী কেন্দ্রীয় উদ্যান পার্ক হিসেবে জেলা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হয়।

অতীতের স্মৃতি বিজড়িত কাহিনির ভারে এই রাজবাড়ি আজও উজ্জ্বল।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...