১৯৩৮ সাল। ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার পথে অনেকটাই এগিয়েছিল। দেশের তৎকালীন অনেক রাজারা সাহায্য করছেন বিপ্লবীদের। এক রাজবাড়ির কাছারি মাঠে সেদিন এক কর্মী-সভা আয়োজন করেছে নানান গুপ্ত বিপ্লবী সমিতি মিলে। বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স গ্রুপের মেদিনীপুর শাখার কর্মীরা চাঁপা ফুলের মালা পরিয়ে শঙ্খধ্বনি দিতে দিতে নিয়ে আসছেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে।
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ভাষণ শুনে সেদিন উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন অসংখ্য যুব-বিপ্লবীরা। নেতাজি দীনেশ গুপ্তকে বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের মেদিনীপুর শাখার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। এই সব কার্যকলাপে তৎকালীন এক রাজার উদ্যোগ ছিল অনেকখানি। তিনি প্রত্যক্ষভাবে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে জড়িয়ে পড়েছিলেন। সরাসরি বিরোধিতা করেছিলেন ইংরেজদের। দেবেন্দ্রলাল খান। ব্রিটিশ সরকারের কাছে কোনোভাবেই মাথা নত করেননি।
এমনকি ১৯২০ সালে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে রাজা বাহাদুর উপাধি দিতে চাইলেও অস্বীকার করেছিলেন নিতে। আসলে এই রাজা উপাধি দেওয়ার পেছনে ব্রিটিশ সরকারের প্রকৃত মানসিকতা দেবেন্দ্রলাল খানকে বুঝিয়েছিলেন স্বয়ং চিত্তরঞ্জন দাশ। এভাবেই নাড়াজোল রাজবাড়ি প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পড়েছিল ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে। ১৯২৫ সালে মহাত্মা গান্ধীও নাড়াজোল রাজবাড়িতে অস্পৃশ্যতা বিষয়ে বক্তব্য রেখেছিলেন।
শোনা যায় সেই সময়কার সংরক্ষণশীল সমাজে এই পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে রাজবাড়ির মানুষজনকে বিরাগভাজন করেছিল অনেক সাধারণ মানুষের। তবুও এই রাজবাড়ির প্রত্যেক সদস্য বরাবর অন্যায়, অবিচার, কুপ্রথা, কুসংস্কার সবকিছুর বিরোধিতা করে এসেছে।
ভারতবর্ষের স্বাধীন হওয়ার পথে এমন অনেক অগণিত মানুষের ভূমিকা ছিল যাঁদের নাম হয়ত আমরা ইতিহাসে কোথাও পাই না। মেদিনীপুরের নাড়াজোল রাজবাড়ির রাজা দেবেন্দ্রলাল খান তেমনই এক মানুষ। শোনা যায় নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু যখন ভিয়েতনামে ছিলেন তাঁর চিকিৎসার সম্পূর্ণ খরচের দায়িত্ব নিয়েছিলেন দেবেন্দ্রলাল খান।
আনুমানিক ষোড়শ শতকে নাড়াজোল জমিদার বংশের সূচনা করেছিলেন উদয়নারায়ণ ঘোষ। প্রায় ছ'শ বছরের অতীত নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে এই রাজবাড়ি। রাজপ্রাসাদ ক্ষয়াটে, ইটের চওড়া দেয়ালে ফাটল, আগাছা ও জঙ্গলে ভর্তি। রাজবাড়ির দুটি অংশ। পরিখা দিয়ে ঘেরা ভেতরের অংশ আর বাইরে বাহিরমহল। ভেতরে ঢোকার লালমাটির সরু রাস্তা চলে গেছে ঘাসের উপর দিয়ে।
শোনা যায় উদয়নারায়ণ ঘোষ বর্ধমান রাজার দেওয়ান ছিলেন। নাড়াজোল তখন ছিল গভীর জঙ্গলে থাকা অরণ্যভূমি। জনমানস তেমন ছিল না বললেই চলে। আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের ‘নাড়াজোল‘ শব্দটিকে ব্যাখ্যা করেছেন। মেদিনীপুর অঞ্চলে ধান কেটে নেওয়ার পর ধান গাছের যেটুকু মাঠে থেকে যায় তাকে বলা হয় ‘নাড়া’, আর জোল কথাটি জলার অপভ্রংশ। শিলাবতী, কংসাবতী, পারাং এলাকাটি বছরের বেশিরভাগ সময় জলে ডুবে থাকত। তাই নাকি ওই অঞ্চলের নাম হয়েছিল নাড়াজোল।
একবার উদয়নারায়ণ ঘোষ জঙ্গলে শিকার করতে এসেছিলেন, সন্ধ্যে হয়ে যাওয়ায় তিনি পথ হারিয়ে ফেলেন। বন্য প্রান্তরে সূর্য ডুবে যাওয়ার মুহূর্তে এক অদ্ভুত অলৌকিক দৃশ্য নাকি দেখেছিলেন তিনি। একটি বক ও বাজপাখির যুদ্ধে অসীম সাহসে বক বাজপাখিকে আক্রমণ করছে আর জায়গাটি আলোয় ভরে উঠেছে। সেই রাত্রেই দেবী দুর্গাকে স্বপ্নে দেখেন রাজা উদয়নারায়ণ।
কথিত আছে, পরের দিন আবার ওই জায়গায় ফিরে গিয়ে দেবীর সোনার মূর্তিসহ প্রচুর ধন-সম্পদ উদ্ধার করেছিলেন রাজা উদয়নারায়ণ। তিনি নাকি নাড়াজোলেই পাকাপাকিভাবে থেকে গিয়েছিলেন। তাঁকে সঙ্গ দিয়েছিলেন কিছু স্থানীয় নিম্নবর্গের মানুষেরা। উদয়নারায়ণ ঘোষ নাড়াজোল অঞ্চলে তৈরি করেছিলেন দেবী জয়দুর্গার মন্দির। এমনকি নাড়াজোল রাজবাড়িতে পূজিত হন দেবী জয়দুর্গা। এই রাজা উদয়নারায়ণ তৈরি করেছিলেন নাড়াজোল রাজবাড়ি।
উদয়নারায়ণ ঘোষ-এর পর নাড়াজোলের রাজা ছিলেন প্রতাপনারায়ণ। তারপর উত্তরাধিকারসূত্রে কখনো যোগেন্দ্রনারায়ণ, ভরতনারায়ণ এবং কার্তিকরাম ঘোষ নাড়াজোলের রাজা হয়েছিলেন।
কার্তিকরাম ঘোষ তখনকার আফগান শাসক-এর থেকে রায় উপাধি পেয়েছিলেন। তারপর থেকেই নাড়াজোল রাজবাড়ি রাজাদের পদবী ছিল রায়। আবার ১৫৯৬ সালে পরবর্তী শাসক বলবন্ত রায় বাংলার সুবেদার বা নাজিমের থেকে খান উপাধি পেয়েছিলেন। তখন থেকে জমিদারি প্রথা অবলুপ্ত না হওয়া পর্যন্ত নাড়াজোল রাজবাড়ির সমস্ত রাজাদের পদবী ছিল খান।
নাড়াজোল রাজবাড়ির রাজাদের সঙ্গে শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের যোগ ছিল গভীর। দীর্ঘদিন শরিকি বিবাদে জর্জরিত থেকেছে এই রাজবাড়ির উত্তরাধিকার। তবে মোহনলাল খানের সময় থেকে পরবর্তী প্রায় দেড়শ বছর নাড়াজোল-এর শাসকদের সুবর্ণ যুগ ছিল। মোহনলাল খানের সময় থেকেই স্থাপত্য, সংগীত ও সাংস্কৃতিক বিকাশ ঘটতে শুরু করে নাড়াজোল রাজবাড়িতে। শোনা যায় চুয়াড় বিদ্রোহের সময় কর্ণগড়-এর রানী শিরোমণির সঙ্গে যৌথভাবে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে চুনিলাল খানের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। রাজা মহেন্দ্রলাল খান আবার লোককবি ছিলেন।
ভারত সম্রাজ্ঞী ভিক্টোরিয়া মহেন্দ্রলাল খানকে রাজা উপাধি দিয়েছিলেন। এর পরবর্তীকালে রাজারা বেশিরভাগই কবি ছিলেন। নরেন্দ্রলাল খান-এর স্ত্রী রানী মৃণালিনী দেবীও ছিলেন কবি। নাড়াজোল-এর রাজারা উদারপন্থী ছিলেন।সংরক্ষণশীল মনোভাব ছিল না তাঁদের। মৃণালিনী দেবীর কবিতার বই 'স্তুতিকুসুমাঞ্জলি' প্রকাশিত হয়েছিল। রাজা নরেন্দ্রলাল খান স্বদেশী আন্দোলনে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছিলেন। তাই ইংরেজ সরকার ফিরিয়ে নিয়েছিল তাঁর রাজা উপাধি।
এই নরেন্দ্রলাল খান-এর পুত্র দেবেন্দ্র লাল খান সরাসরি বিপ্লবী কার্যকলাপে অংশগ্রহণ করেছিলেন। অনেক বিখ্যাত মানুষজনের সঙ্গে সংযোগ ছিল এই রাজ পরিবারের। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, জ্ঞানেন্দ্রনাথ বসু, হেমচন্দ্র কানুনগো, ক্ষুদিরাম বসু প্রমুখ মানুষদের নিত্য যাতায়াত ছিল এই রাজবাড়িতে। শোনা যায় ক্ষুদিরাম বসুর বাবা ত্রৈলোক্যনাথ বসু নাড়াজোল রাজ এস্টেটের তহশিলদার ছিলেন।
রাজবাড়ির অন্তরমহলের কারুকার্য অপূর্ব। থামের ওপর দুটি সিংহ রাজবংশের বিক্রম-এর প্রতীক। রয়েছে নহবৎখানা। পুরাতন দিনে এই নহবৎখানা থেকে বাজত বৃন্দাবনী সারাং। সংগীতের দিকে বিষ্ণুপুর ঘরানা সঙ্গে যোগ ছিল এই রাজবাড়ির। নাড়াজোল অঞ্চলে শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রসার ঘটিয়েছিলেন নাড়াজোল-এর রাজারা। পরবর্তীকালে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ও স্থাপন করেছিলেন। এই রাজবাড়িতে দেবেন্দ্রলাল খান উত্তোলন করেছিলেন দেশের জাতীয় পতাকা। সংরক্ষণের অভাবে এই রাজবাড়ির দশা বর্তমানে ভগ্নপ্রায়। তবে চেতনা, বিপ্লব ও অন্তরালোকে আলোকিত এই রাজবাড়ি তাঁর স্বমহিমায় উজ্জ্বল।