মেদিনীপুর শহর থেকে একটু ভেতরে। মহিষাদল রাজবাড়ি। ইতিহাস সমৃদ্ধ। তিনটি মূল প্রাসাদ নিয়ে গড়ে ওঠা। রঙ্গিবসান, লালকুঠি এবং ফুলবাগ। একমাত্র ফুলবাগের গায়েই এখনও লেগে থাকে মানুষের গন্ধ। এই রাজবাড়িটিকে সংরক্ষণ করা হয়েছে। ফলে যাওয়া আসা চলে এখানে। পর্যটকদের সপ্তাহান্তে ভ্রমণের সঙ্গী। বাকি দুটি রাজবাড়ি সংরক্ষিত নয়। প্রবেশ অধিকার নেই এখানে।
ফুলবাগ প্রাসাদ বিস্তৃত জায়গা জুড়ে রয়েছে। আভিজাত্যের ছাপ সুস্পষ্ট। চওড়া দালান, কড়িকাঠের সিলিং সব মিলিয়ে সেই পুরাতনের ছাপ। এই প্রাসাদের সঙ্গে রয়েছে দিঘী, পুকুর এবং কুলদেবতা মদন গোপাল জিউয়ের মন্দির। এছাড়াও এই রাজবাড়ির সঙ্গে আছে দুর্গামন্ডপ। অতীতের স্মৃতি নিয়ে ঝাড়বাতি দোলে সেই মন্ডপে।
এছাড়াও রয়েছে একটি বিশাল কামান।শোনা যায় দুর্গাপুজোর সময় এই কামান দাগা হত। কামানের আওয়াজে আশেপাশের অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ত পুজোর সুর আর গন্ধ। পুজোর সূচনা হত এই কামান দাগার মাধ্যমে।
এই প্রাসাদেই রয়েছে একটি মিউজিয়াম। পুরনো জিনিসপত্র সংরক্ষিত রয়েছে। এই রাজবাড়ির রাজাদের শিকার করার শখ ছিল। তাঁদের শিকারের সময় ব্যবহৃত জিনিসপত্র, শিকারের ফলে নানা সংরক্ষিত অবশেষ আজও অতীতের সঙ্গে দেখা করায় সহজেই।
মহিষাদল রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা জনার্দন উপাধ্যায়। মুঘল সম্রাট আকবরের সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মচারী ছিলেন তিনি। ষষ্ঠদশ শতকে উত্তরপ্রদেশ থেকে এসেছিলেন এই জনার্দন উপাধ্যায়। ব্যবসাই ছিল মূল লক্ষ্য। তবে ভাগ্য রচনা করেছিল অন্য কাহিনী। মহিষাদল-এর গেঁওখালিতে এসেছিলেন এই ব্যবসায়ী। সে সময় ওই অঞ্চলের রাজা ছিলেন কল্যাণ রায় চৌধুরী। রাজধানী ছিল গড়গুমাই। কল্যাণ রায়চৌধুরী থেকে মহিষাদলের নতুন স্বত্ব কিনে নেন জনার্দন উপাধ্যায়। কিন্তু এত সহজে নিজের রাজত্ব কল্যাণ রায় চৌধুরী ছেড়ে দিয়েছিলেন মূলত একটি কারণে। রাজস্ব সময় মত দিতে না পারায় তাঁর রাজত্ব নিলাম হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। তাই একপক্ষের প্রজাদের মঙ্গলের জন্যই নিজের রাজত্ব বিক্রি করে দেন এই রাজা। মহিষাদল এসে পড়েছিল প্রকৃত মানুষের হাতে।
সম্রাট আকবরের কাছের মানুষ ছিলেন জনার্দন উপাধ্যায়। বৈরাম খাঁর নামাঙ্কিত তরবারিও তিনি উপহার পেয়েছিলেন। জনার্দন উপাধ্যায়ের পঞ্চম পুরুষ আনন্দ লাল উপাধ্যায়ের কোন পুত্র সন্তান ছিল না। তাঁর মৃত্যুর পর রানী জানকী রাজত্বের দায়িত্ব নেন। এই রানীর দূর-সম্পর্কের এক জামাই ছক্কনপ্রসাদ গর্গের ছেলে গুরুপ্রসাদ গর্গ রাজা হয়েছিলেন। তারপর দেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত এই গর্গ পরিবার রাজত্ব করেছিলেন মহিষাদলে। সংস্কৃতি মনোভাবাপন্ন পরিবার ছিল এই গর্গ পরিবার। সংগীত চর্চা করতেন নিয়মিত। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের চর্চা এই পরিবারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল। বিংশ শতক জুড়ে শাস্ত্রীয় সংগীত জগতের দিকপাল মানুষেরা নিয়মিত এসেছেন এই রাজবাড়ি তে। ফৈয়জ খাঁ, বড়ে গোলাম আলী এমন সব বিখ্যাত মানুষজনের ব্যবহৃত তানপুরা, তবলা, হারমোনিয়াম সংরক্ষিত রয়েছে এই রাজবাড়ি র মিউজিয়ামে। এর নাম ‘বাজনা ঘর’। এছাড়াও অন্য ঘরে রাজাদের শিকার করা প্রাণীদের নিদর্শন রাখা রয়েছে। মিউজিয়ামে রাজার সেনাদের অস্ত্র, পোশাক, রাজাদের ব্যবহৃত পালঙ্ক রয়েছে। পর্যটকদের জন্য সকাল দশটা থেকে সন্ধ্যা ছটা পর্যন্ত খোলা থাকে মিউজিয়াম।
এই গর্গ পরিবার মহিষাদলকে সংস্কৃতির সঙ্গে বিশেষভাবে যুক্ত করেছিল। তবে এই অঞ্চলের মূল উন্নতি শুরু হয়েছিল উপাধ্যায় পরিবারের হাত ধরে। বিদ্যালয়, হাসপাতাল অর্থাৎ একটি অঞ্চলের সামগ্রিক উন্নতির সম্পূর্ণ প্রচেষ্টা করেছিলেন উপাধ্যায় পরিবারের রাজারা। তারপর গর্গ পরিবার এসে সংস্কৃতির ক্ষেত্রকে প্রসারিত করে। এই পরিবারের শেষ রানী সম্ভবত ২০১১ সালে মারা যান।
গান, বাজনা সব মিলিয়ে অতীতের সংস্কৃতির সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রক্ষা করেছে এই রাজ পরিবারের সদস্যরা। এই রাজবাড়ির সংগ্রহশালা তাই আজও অতীত ভ্রমণ করায়।