রাজবাড়ি: পর্ব ২৫ঃ মহিষবাথানের লালবাড়ি

সল্টলেকের মহিষবাথান। আধুনিকতায় মোড়া ঝাঁ চকচকে সল্টলেক তখনও লবণহ্রদ ছিল। ১৯৫৮ সালের এক শরতের সকাল। একটি মোটর গাড়ি এসে থামল লবণহ্রদের মহিষবাথানের কাছে। গাড়ি থেকে এক দীর্ঘদেহী মানুষ বেরিয়ে এলেন। তাঁর সঙ্গে এসেছিলেন কোট-প্যান্ট পরা সাদা চামড়ার ভদ্রলোক। এই দুজনকে আনন্দের সঙ্গে অভিবাদন জানালে এক ধুতি, পাঞ্জাবি পরা সৌম্যকান্তি ভদ্রলোক। তাঁর চোখে মুখে রাজ পরিবারের শৌর্য ছড়িয়ে পড়ছে। তৎকালীন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় সেই সময়কার মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে নিয়ে মহিষবাথানের এই রাজবাড়িতে এসেছিলেন। এটি আসলে মহিষবাথানের লালবাড়ি হিসেবে পরিচিত।

mahisbathan

সল্টলেক তখন ছিল লবণহ্রদ। এটি সুন্দরবনের নোনা জল অধ্যুষিত এলাকা হিসেবেই পরিচিত ছিল। এই অঞ্চলে বিদ্যাধরী নদী ছিল গভীর। তবে মালবাহী জাহাজ যাতায়াত করত নদীপথে। পরবর্তীকালে ধীরে ধীরে ভৌগোলিক চেহারার পরিবর্তন হয়ে এই অঞ্চলে কৃষি কাজ শুরু হয়। কৃষিকাজ, গোচারণ, মাছের ভেড়ি অধ্যুষিত এলাকায় বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষরাও এসে বসবাস শুরু করেন। লোকালয় হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল এই লবণহ্রদ অঞ্চল। এমনই অধিবাসী ছিলেন মহিষবাথানের লাল বাড়ির পূর্বপুরুষরা। তাঁরা উত্তরবঙ্গ থেকে এই অঞ্চলে এসেছিলেন। এঁদের মূলত ছিলেন মৎস্যজীবী। ক্ষত্রিয় হওয়ায় সাহসী, বুদ্ধিমান ছিলেন‌ এঁরা। ১৭৫৭ সালে নবাব সিরাজদৌলার মৃত্যুর পর এই লবণহ্রদ এলাকার মালিকানা পরবর্তী নবাব ও বংশধরদের হাত থেকে ইংরেজের হাতে এসে পড়ে। ১৭৮৪ সাল থেকে ইংরেজরা মাছের ভেড়ি আর কৃষিজমির বন্টন প্রক্রিয়া শুরু করে। বিভিন্ন জমিদারদের হাত ঘুরে মহিষবাথানের লালবাড়ির মালিকদের হাতে যায় এই অঞ্চল।

মহিষবাথান রাজবাড়ি বা লালবাড়ির সূচনা হয় গোবর্ধন প্রামাণিকের হাত ধরে। পরবর্তীকালে তাঁর সন্তানরা এটিকে বিরাট প্রাসাদে পরিণত করেন। চেষ্টা করেছিলেন সাধ্যমত এই বাড়িতে সাজানোর। মোট ছয় বিঘা জমির উপর বাড়িটি। সুদর্শন ও দামী আসবাবপত্র দিয়ে সাজানো ছিল এই বাড়ি। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সব নষ্ট হয়েছে। লালবাড়ির অনেক ঘরও ভেঙে গেছে। এখন ৫২টির মত ঘর রয়েছে। প্রাচীন কোন আসবাবপত্রের দেখা আর মেলে না।

এই লালবাড়ির অরন্ধন উৎসব ছিল বিখ্যাত। লালবাড়ি জমিদাররা সমস্ত গ্রামবাসীদের খাওয়াতেন এই পুজোয়। বর্তমানে বিশ্বকর্মা পুজো অর্থাৎ রান্নাপুজো বলে আমরা যেটিকে জানি, অনেক পরিবারেই সেই সময় এখনো এই অরন্ধন উৎসব পালিত হয়। আজ থেকে প্রায় ৩০০ বছর আগেও এই অরন্ধন উৎসব পালন করত এই রাজবাড়ি। অনেকে এই লালবাড়িকে রাজবাড়ি হিসেবে মানতে নারাজ। তাঁদের মতে সম্ভ্রান্ত জমিদার পরিবার এঁরা।

স্বাধীনতা আন্দোলনে এই লালবাড়ি তীর্থক্ষেত্রের মত ছিল। মহিষবাথান গ্রাম ছিল স্বাধীনতা আন্দোলনকারীদের মন্দির। ব্রিটিশদের সঙ্গে এই পরিবারের প্রথম সমস্যা তৈরি হয় কৃষ্ণপুর খাল কাটার সময়। ব্রিটিশ সরকার এই পরিবারের বিরুদ্ধে মামলা করে। শুরু হয় বিরোধিতা। এর সঙ্গে যোগ হয় দেশের প্রতি ভালোবাসা। গোবর্ধন প্রামাণিকের উত্তর পুরুষ লক্ষীকান্ত প্রামাণিক এই পরিবারের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য স্বাধীনতা আন্দোলনকারী। গান্ধীজীর নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। রাজা হয়েও আনন্দের সঙ্গে কারাবরণ করেন। গান্ধীজীর অহিংস নীতির তাঁকে প্রভাবিত করেছিল। কথিত আছে গান্ধীজীর মতাদর্শে নিজেকে দীক্ষিত করার স্বপ্ন দেখতেন তিনি। মহিষবাথান অঞ্চলে লবণ আন্দোলন শুরু করেছিলেন তিনি। গান্ধীজীর প্রত্যেকটা কথা তাঁকে উদ্বুদ্ধ করত লড়াই করতে। হিংসাবিহীন লড়াই।‌ তবে গান্ধীজীর শিক্ষানীতির ওপর ভরসা ছিল লক্ষীকান্ত প্রামাণিকের। তিনি জানতেন শিক্ষিত না হলে কোন লড়াই টিকে থাকে না। যুদ্ধের আসল অস্ত্র সঠিক শিক্ষা। এই ব্রতকে জীবনের লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন তিনি।

কাজ শুরু করেছিলেন নিজের অঞ্চলেই। নিরক্ষরতা দূরীকরণে জাতীয় বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন মহিষবাথানে। অনেক জাতীয় আন্দোলনের মূল কেন্দ্র ছিল মহিষবাথানের এই লাল বাড়ি। কিন্তু ব্রিটিশরা আন্দোলনে এক রাজ পরিবারের এইভাবে সক্রিয় অংশগ্রহণ মোটেই ভালোভাবে মেনে নেয়নি। শুরু হয় তীব্র অত্যাচার। লক্ষীকান্ত প্রামাণিকের সকল ভাইও কারাবরণ করতে বাধ্য হয়। ছাড় পায়নি নারীরাও। অন্তঃপুরে নারীদের সকল অলংকার ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিল।

মহিষবাথানের এই লালবাড়িতে তখন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, বিপ্লবী যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত ও তাঁর স্ত্রী নেলী সেনগুপ্তের রোজ যাতায়াত ছিল।

এরপর স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ভারতবর্ষের নানা কুসংস্কারে বিরুদ্ধেও লড়েছিলেন এই রাজ পরিবার। বিধবা বিবাহ প্রবর্তনের পর লক্ষ্মীকান্ত প্রামাণিক তাঁর নিজের আশেপাশের অঞ্চলের সকল বিধবাদের বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিলেন। ফলে অনেকেরই বিরাগভাজন হয়েছিলেন। কিন্তু একটুও দমে যাননি তাতে। শোনা যায় ওই অঞ্চলের নামকরা পুরোহিতরা বিধবা বিবাহ দিতে অস্বীকার করতেন, লক্ষীকান্ত প্রামাণিক তখন নানা অঞ্চল ঘুরে পুরোহিত খুঁজে নিয়ে আসতেন বিধবা বিবাহের জন্য। লবণহ্রদ অঞ্চলের মহিষবাথানের উন্নতির স্তম্ভ ছিল এই পরিবার।

রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এই রাজবাড়ি এখন ভগ্নপ্রায়। শুধু পুরনো স্মৃতির মত আগাছা, বুড়ো বটগাছ আগলে রাখে রাজবাড়ি। তবে এই রাজ পরিবারের কিছু বংশধর এখনও রয়েছেন এখানে। নিজেদের বাসস্থানের তাগিদেই কিছুটা রক্ষণাবেক্ষণ করেন তাঁরা। বাকি ইতিহাস সবটাই স্মৃতিতে সুরক্ষিত।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...