কৃষ্ণনগর পুলিশ ফাঁড়িকে বাঁদিকে আর মূল বাসস্ট্যান্ডকে ডান দিকে রেখে সোজা রাস্তা ধরে এগিয়ে গেলেই কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির চক। রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সঙ্গে যোগ রয়েছে হাসির রাজা গোপাল ভাঁড়ের। তবে মূল রাজবাড়ি রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের পূর্বসূরীদের তৈরি। ইতিহাসের পাতায় এই রাজবাড়ি অনেকটা জায়গা দখল করেছিল রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের আমলে। তাই রাজবাড়ি শুধুই ইতিহাসের কথা শোনায় না, এই রাজবাড়িকে ঘিরে নানা গল্প ভেসে বেড়ায় বাতাসে। কখনও সেই সব গল্প আমাদের জীবনের সঙ্গে জুড়ে যায়।
এই রাজবাড়িতে মহাসমারোহে পূজিতা দেবী জগদ্ধাত্রী। এমনি সময় মূল রাজবাড়িতে প্রবেশ নিষিদ্ধ। তবে বাইরে থেকে ভগ্নপ্রায় চকবাড়ি, নহবতখানা আর রাজবাড়ির বিরাট পুকুর দেখা যায়। সোঁদা গন্ধ লেগে রয়েছে দেওয়ালের প্রত্যেকটা ইট, কাঠ পাথরে।
বাংলার নবাব তখন আলীবর্দী খাঁ। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র একবার নবাবকে রাজস্ব দিতে পারেননি সঠিক সময়ে। যথারীতি নবাবের শ্রীঘরে বন্দী থেকেছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র। পরে রাজস্বের ব্যবস্থা করে মুক্তি পান রাজা কৃষ্ণচন্দ্র।
তখন দুর্গাপুজোর সময়। কৃষ্ণচন্দ্রের প্রপিতামহ মহারাজা রুদ্র রায়ের আমল থেকে দুর্গাপুজো হত এই রাজবাড়িতে। এদিকে নবাবের কাছ থেকে মুক্তি পেতে পেতে পেরিয়ে যায় বিজয়াদশমী। তাই ফিরে এসেও ভারি বিষন্ন হয়ে পড়েন রাজা কৃষ্ণচন্দ্র।
একদিন অবসন্ন হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। কারণ এই প্রথমবার রাজবাড়ির প্রচলিত দুর্গাপুজো 'রাজরাজেশ্বরী'র আরাধনায় বিঘ্ন ঘটে। শোনা যায় সেই রাতে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র স্বপ্নে দেখেছিলেন এক রক্তবর্ণ চতুর্ভূজা কুমারী দেবীকে। সেই দেবী তাঁকে বলেছিলেন আগামী কার্তিক মাসের শুক্লা নবমী তিথিতে তার পুজো করতে। সেই স্বপ্নের চতুর্ভূজা সিংহাসনে আসীন কুমারী দেবীর মূর্তি নির্মাণ
করিয়েছিলেন রাজা কৃষ্ণচন্দ্র। তাঁকে স্থাপন করেন রাজপ্রাসাদের নাটমন্দিরে। সেই দেবীমূর্তির বাঁ পা একটু ভাঁজ হয়ে সোজাসুজি যোদ্ধারূপে বসা। সেই থেকে এই রাজবাড়ির নাটমন্দিরে জগদ্ধাত্রী পূজার প্রচলন হয়।
কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ভারতের স্বাধীনতা এবং পরাধীনতা দুই-এর ইতিহাস। নবাব আলীবর্দী খাঁর মৃত্যুর পর তাঁর দৌহিত্র বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজের বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতার সঙ্গে নাম জড়িয়েছিল রাজা কৃষ্ণচন্দ্রেরও। তাই কোথাও যেন দেশের পরাধীনতার সূত্রে জড়িয়ে রয়েছে এই রাজবাড়ির নাম।
আবার স্বাধীনতার আলোর সঙ্গেও জড়িয়ে রয়েছে এই রাজবাড়ির নাম। ১৯৪৭ সালে ভারত যখন স্বাধীন হয় কৃষ্ণনগর পড়েছিল পূর্বপাকিস্তানে। সেই সময়ে কৃষ্ণনগরের রানী ছিলেন জ্যোতির্ময়ী দেবী। তিনি লর্ড মাউন্টব্যাটেন-এর সঙ্গে দেখা করে দাবি জানান কৃষ্ণনগরকে ভারতবর্ষে অন্তর্ভুক্ত করার। মাউন্টব্যাটেন মেনে নেন রাণীর কথা। অবশেষে ১৭ই আগস্ট কৃষ্ণনগরের ভারতে অন্তর্ভুক্তি ঘোষণা করা হয় রেডিয়োতে। ১৮ই আগস্ট এলাকায় ভারতবর্ষের পতাকা প্রথমবার উত্তোলিত হয়। সমগ্র কৃষ্ণনগর জুড়ে সেদিন শুরু হয়েছিল উৎসব। রানী জ্যোতির্ময়ী দেবীর নামে আজও একটি বালিকা বিদ্যালয় রয়েছে কৃষ্ণনগরে।
কৃষ্ণনগর জনপদের আগের নাম ছিল 'রেউই'। শোনা যায় কৃষ্ণের দাদা বলরামের স্ত্রীর নাম অনুসারেই এই নামকরণ হয়েছিল। পরে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের প্রপিতামহ রুদ্র রায় তাঁর কৃষ্ণ-ভক্তির প্রমাণ স্বরূপ এই জনপদের নাম রাখেন কৃষ্ণনগর। তিনি ঢাকা থেকে এক স্থপতিকে আনিয়ে গড়েছিলেন এই রাজবাড়ি। কাছারি বাড়ি, হাতিশালা, আস্তাবল, নহবৎখানা, সবই তাঁর আমলে নির্মিত। মুঘল আমলের বিভিন্ন কারুকার্যে নির্মিত হয়েছিল নাটমন্দির এবং রাজতোরন।
এখনো কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে দুর্গাপুজা হয়। চৈত্র মাসের শুক্লা একাদশী থেকে টানা একমাস রাজবাড়ির পাশে বিশাল মাঠে অনুষ্ঠিত হয় বারাদোলের মেলা। সেই মেলার প্রথম তিনদিন সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকে রাজবাড়ির নাট মন্দির। ওই তিনদিন রাজবাড়ির নাটমন্দিরের কুলদেবতা এবং অন্যান্য বিগ্রহ পূজিত হয়। ধর্ম, ইতিহাস সব মিলিয়ে এই রাজবাড়ি যেন অন্তরঙ্গ কথার পাহাড়, যার প্রত্যেকটা দেওয়াল আজও শুধু স্মৃতির কথা বলে।