রাজবাড়ি পর্ব ৮ঃ কর্ণগড় রাজবাড়ি

মেদিনীপুর শহর থেকে তিন-চার কিলোমিটার দূরে ভাদুতোলা এলাকা। তারপর শালবন আর ধানক্ষেতের মাঝে সরু পিচের রাস্তা ধরে এগিয়ে গেলেই কর্ণগড়। অখ্যাত জায়গা। জঙ্গলের ভেতর ভগ্নস্তূপ। ইতি-উতি ছড়িয়ে থাকা স্মৃতিরা। ইতিহাস, অতীত আর লড়াই মিশিয়ে রাতচরা পাখির মতই রহস্যময় কর্ণগড়। এই অঞ্চলেই অবস্থিত মেদিনীপুরের বিখ্যাত মহামায়া মন্দির। মন্দির থেকে অল্প দূরে পারাং নদী পেরিয়েও যাওয়া যায় কর্ণগড় রাজবাড়ি

প্রায় ১২০ বিঘা জমির ওপর এই কর্ণগড় রাজপ্রাসাদ। সংরক্ষণের অভাবে রাজপ্রাসাদ ভগ্নস্তূপে রূপান্তরিত। তবে এই রাজপরিবারের আরও দুই প্রাসাদ ছিল আবাসগড় ও জামাগড়ে। মতভেদ রয়েছে এই রাজপরিবারের প্রতিষ্ঠাতা নিয়ে। কেউ বলেন উড়িষ্যার কেশরী বংশের ইন্দ্রকেতু নামে এক রাজা এই প্রথম এই রাজপ্রাসাদ  তৈরী করেন। কোনও কোনও ঐতিহাসিকের মতে মহাবীর সিংহ ছিলেন এই প্রাসাদের প্রতিষ্ঠাতা। তবে সুরথ সিংহ নামে রাজার সময়কাল থেকে বংশানুক্রম পরিষ্কার।

এই বংশের শেষ রাজা ছিলেন অজিত সিংহ। লক্ষ্মণ  সিংহের উত্তর পুরুষ যশোবন্ত সিংহের পুত্র এই অজিত সিংহ। অজিত সিংহ ছিলেন সন্তানহীন। তাঁর দুই স্ত্রী রানি ভবানী ও রানি শিরোমণি। ১৭৬০ সালে মৃত্যু হয়েছিল অজিত সিংহের। তাঁর মৃত্যুর পর রাজ-পরিবার পরিচালনার ভার নিজের হাতে তুলে নেন রানি শিরোমণি। প্রায় চল্লিশ বছর তিনি প্রজাদের দায়ভার সামলেছিলেন। যখন রাজ্য চালানো শুরু করেছিলেন কর্ণগড়ের রানি তখন নেহাত কিশোরী। সন্তানহীনা রানির কাছে প্রজারা ছিলেন সন্তানসম।

পারাং নদীর পাশ দিয়ে এই রাজপ্রাসাদ। শাল, শিশু, কেন্দ, আমলকীর ঘন অরণ্যের মাঝে এই রাজপ্রাসাদ। মাকড়া পাথরে নির্মিত এই রাজবাড়ির সৌন্দর্য অপরূপ। প্রাসাদ সংলগ্ন বিশাল পুকুর শোভা বর্ধন করত রাজবাড়ীর। রাজমহলের সদস্যদের নৌবিহারের উপযোগী জলাশয়ও ছিল।

 

Karnagarh1

দক্ষিণের হাম্পির স্থাপত্যের সঙ্গে মিল ছিল এই রাজবাড়ির মন্দিরের। কর্ণগড় রাজপ্রাসাদের সংলগ্ন দেবী মহামায়ার মন্দির। অষ্টধাতুর মূর্তিসমেত এই মন্দিরের একদিকে পঞ্চমুনির আসন। এখানে নাকি সাধনা করে সিদ্ধিলাভ করেছিলেন কর্ণগড়ের রাজা। এছাড়াও এই রাজপরিবারের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে আরও অনেক মন্দিরের উপাখ্যান। যেমন দণ্ডেশ্বর মন্দির। মন্দিরের পেছনে রয়েছে রাজপরিবারের অব্যবহৃত তোরণদ্বার। মন্দিরে ছড়িয়ে রয়েছে যত্নের ছোঁয়া। এই মন্দিরের পাশের তোরণদ্বারই এক সময় ছিল রাজবাড়ির প্রবেশদ্বার। দূরদূরান্ত থেকে ভক্তেরা আসেন এই মন্দিরে। বিশেষ পূজা-পার্বণে লোকসমাগম চোখে পড়ার মতো।

বক্সার যুদ্ধের পর এলাহাবাদ চুক্তি অনুযায়ী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পাানি বাংলার রাজস্ব আদায়ের অধিকার লাভ করে। শুরু হয় অন্যায়ভাবে রাজস্ব আদায়। বিদ্রোহ শুরু হয়। ছড়িয়ে পড়ে সারা ভারতে। ছড়িয়ে পড়ে ভূমিহারা মেদিনীপুরের জঙ্গলমহলের লোধা, কুড়মি, মাঝি, চূয়াড় সম্প্রদায়ের মধ্যেও। এর নাম ছিল চূয়াড়  বিদ্রোহ। মোট চার দফায় হয়েছিল এই বিদ্রোহ। শেষ দফার চূয়াড় বিদ্রোহে সক্রিয় ভূমিকা ছিল রানি শিরোমণির। ১৭৯০ সালে রানির নানাকর জমি বাজেয়াপ্ত করে ইংরেজরা।

বেআইনিভাবে। রানি তখন প্রজাদের একত্রিত করে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামেন। রানির সেনাপতি আবাসগড়ের দুর্গ থেকে সেনা পরিচালনা করতে থাকেন। রানির নেতৃত্বে চারশো জনের চূয়াড়বাহিনী চন্দ্রকোণায় ইংরেজদের সরকারি অফিস লুঠ করে।

এদিকে ইংরেজরাও মরিয়া। ইংরেজরা মেদিনীপুর পৌঁছোয়, গ্রেপ্তার হন রানির দুই সেনাপতি। নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় তাঁদের। রানির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেন তাঁর অন্য এক সেনাপতি। রানি গুপ্ত পথে আবাসগড় পৌঁছতে গিয়ে বন্দি হলেন ব্রিটিশদের হাতে। বিচারে তাঁর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। তবে অনুমতি ছিল কর্ণগড়ে আসার। কিন্তু কখনোই আর ফিরে আসেননি রানি শিরোমণি। ১৮৯৯ সালে মৃত্যু হয় তাঁর। তবে অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন এই মৃত্যু স্বাভাবিক ছিল না। কর্নগড়ের অজানা ইতিহাস আজও এই বিদ্রোহের কাহিনী শোনায় ফিসফিসিয়ে। মেদিনীপুরে গেলে এই রাজপ্রাসাদের ভগ্নস্তূপ আজও শোনায় সেই লড়াইয়ের কথা।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...