কালনা। দু’পাশে সবুজকে রেখে পথচলা। চলতে চলতে সময় পার হয়ে যায়। তবুও পথ শেষ হয় না। অবশেষে পথের পারে মানুষের দেখা মেলে। কালনার ১০৮ শিব মন্দির। মন্দিরের বাইরে মানুষের আনাগোনা। ঘুগনি, ফুচকার দোকান। তখন বিকেলবেলা। আলগোছে বয়ে চলা অভ্যেস বন্ধুর হাত ধরে বেড়াতে বেরোয়। বোঝা যায় এই রাস্তা ওর চেনা। মন্দির জুড়ে ফুলের গন্ধ। ধূপ, ধুনো আর মানুষের গন্ধ। কাছেই রাসমঞ্চ। জনশ্রুতি রয়েছে, যে একসময় রাজবাড়ির সদস্যদের উপস্থিতিতে দোলযাত্রার সময় সাত দিনব্যাপী এই মঞ্চে রাধাকৃষ্ণের মূর্তি থাকত। রাসলীলা অনুষ্ঠিত হত। কোন সুড়ঙ্গ পথ নাকি রয়েছে এই রাসমঞ্চের নীচে। কত ইতিহাস! ভালোবাসার, জীবনের।
কিছুটা দূরেই কালনা রাজবাড়ি। কেউ আবার বলে আসলে জমিদারবাড়ি। পূর্ব বর্ধমান জেলার কালনা এই রাজ্যের প্রাচীন শহর। কালনা মূলত টেরাকোটা শিল্পের জন্য বিখ্যাত। মন্দির পরিবেষ্টিত এমন রাজবাড়ি কম রয়েছে। জনপথ হিসেবেও কালনা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। বৈষ্ণব ধর্ম প্রবর্তনের পর গঙ্গার ওপারে শান্তিপুর এবং এপারে কালনার প্রাধান্য বৃদ্ধি পেয়েছিল।
বর্ধমান রাজপরিবার মূলত বৈষ্ণব ভাবধারায় প্রভাবিত ছিল। বর্ধমান রাজপরিবার কালনাতে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য মন্দির স্থাপন করেছিল। এই মন্দির তৈরির জন্যই ১৮৩১ সালে রাজপথ নির্মাণ করিয়েছিলেন রাজা তেজচন্দ্র। একে কেন্দ্র করে প্রতি আট মাইল অন্তর জলাশয়, বাংলো, আস্তাবল নির্মিত হয় ধীরে ধীরে।
কালনা রাজবাড়ি চত্বরের সবচেয়ে পুরনো মন্দির ২৫ টি চূড়া বিশিষ্ট লালজি মন্দির। ১৭৩৯ সালে এই মন্দির নির্মাণ করিয়েছিলেন বর্ধমানের জমিদার কীর্তিচন্দ্রের মা ব্রজকিশোরী দেবী। ব্রজকিশোরী দেবী ছিলেন রাধারানীর ভক্ত। রাধিকা মূর্তিকে অন্তর থেকে পুজো করতেন। রাধাকৃষ্ণের প্রতি তাঁর ভক্তি ছিল অসীম। নিজের রাধিকা মূর্তির সঙ্গে তিনি বিয়ে দিয়েছিলেন এক সন্ন্যাসীর কাছে থাকা শ্যামরায়-এর। সন্ন্যাসী তাঁর লালজিকে নিজের হাতে গড়া পোড়া রুটি ভোগ দিতেন। শ্যামরায় অর্থাৎ লালজির মূর্তিকে রাজার জামাতা হিসেবে পুজো করা হয় এখনও।। ভোগ হিসেবে দেওয়া হয় পোড়া রুটি। তবে সঙ্গে অন্যান্য ব্যঞ্জনও দেওয়া হয়।
লালজি মন্দির চারিদিকে সুউচ্চ প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। লম্বা চওড়ায় প্রায় ৫৪ বর্গফুট। ৪ ফুট বেদির ওপরে অবস্থিত এই মন্দির। এই মন্দিরের সামনে রয়েছে নাট মন্দির। এছাড়াও আছে নহবতখানা। এখানেই রয়েছে একটি রাসমঞ্চ।
এই রাসমঞ্চের পাশেই একটি শিবমন্দির আছে যেখানে প্রতাপেশ্বর শিবলিঙ্গ অধিষ্ঠিত।
কালনা রাজবাড়ি এক সময় জনসমাগমে পূর্ণ থাকত। ঝাড় লন্ঠনের আলোয় আলোকিত হত প্রতি রাতে। রথযাত্রার সময় বিশেষ উৎসব আয়োজিত হত এখানে।
লালজির মন্দিরের পর ১৭৫২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল কৃষ্ণচন্দ্রের মন্দির। মোট ২৫ টি চূড়া বিশিষ্ট এই মন্দির। এই মন্দিরের গায়ে রয়েছে টেরাকোটার কাজ। ১৮৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল আরেকটি মন্দির। রেখ দেউলের মন্দির। এই মন্দিরের সামনে রয়েছে একটি নাটমণ্ডপ এবং আরেকটি পর্বত আকৃতি মন্দির যা গিরিগোবর্ধন নামে পরিচিত। এই মন্দিরে দেখা যায় পোড়ামাটির কাজ। মন্দিরের গায়ে রয়েছে পোড়ামাটির জমকালো অলংকরণ। মন্দিরের কাছেই আছে ছাদবিহীন রাসমঞ্চ। এছাড়াও এখানেই প্রতিষ্ঠিত রয়েছে শ্যামচাঁদ রাধারানী মন্দির।
কালনার অন্যতম মূল আকর্ষণ ১০৮ শিব মন্দির। এই মন্দির স্থানীয়দের কাছে নবকৈলাস মন্দির হিসেবে পরিচিত। ১৮০৯ সালে মহারাজা তেজচন্দ্রবাহাদুর এই আটচালা মন্দিরগুলি তৈরি করেন। মন্দিরগুলি দুটি বৃত্তের আকারে বিন্যস্ত। একটি বৃত্তের ৭৪ টি, অপর বৃত্তে ৩৪টি মন্দির অবস্থান করছে। প্রথম বৃত্তের মন্দিরগুলিতে প্রতিষ্ঠিত শিবলিঙ্গ শ্বেত অথবা কষ্টি পাথরের, পরের বৃত্তের মন্দিরগুলি কেবলমাত্র শ্বেত পাথরেই নির্মিত। জপমালার প্রতীক হিসেবে মন্দিরগুলি উপস্থাপিত হয়েছে।
কালনা রাজবাড়ি মূলত মন্দিরের জন্যই বিখ্যাত। মন্দির ও তার কারুকার্য দেখতে দেশ-বিদেশ থেকে পর্যটক আসেন প্রতিবছর। এভাবেই ইতিহাস পাড়ি দেয় এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে। স্মৃতির গন্ধ বয়ে চলতে থাকে নিরন্তর।