রাজবাড়ি পর্ব ৯ঃ ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ি

পৃথিবী জুড়ে তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। অনাহার, মৃত্য, লড়াইয়ের ক্ষতয় জর্জরিত পৃথিবী। কিছু সহানুভূতিশীল মানুষ সেই সময় এগিয়ে এসে সাহায্য করেছিলেন এই পৃথিবীকে তার ক্ষত সারাতে। এ কাহিনি তেমনই এক রাজার। সেই রাজা ঝাড়গ্রামে স্থাপন করেছিলেন দুধকুণ্ডি সমারফিল্ড। আমেরিকার বিমানবাহিনীর সেনাদের সাহায্য করার জন্য। এই সমারফিল্ড থেকে রাজা হাতি, যানবাহন ও অন্যান্য সাহায্যের ব্যবস্থা করেছিলেন। এর অন্য নাম বালিভাসা এয়ারফিল্ড। ঝাড়গ্রাম জেলার মূল অঞ্চল থেকে দুই কিলোমিটার দূরে এই অঞ্চল। ঝাড়গ্রাম থেকে ১৯ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই এয়ারফিল্ড ১৯৪২ সালে তৈরি করেছিলেন রাজা নরসিংহ দেব মল্ল

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন বোমারু বিমান এখান থেকেই যুদ্ধের জন্য জাপান, মায়ানমার, থাইল্যান্ড প্রভৃতি দেশের উদ্দেশে উড়েছিল। ১৯৪৪ সালে মার্কিন বিমানবাহিনীর ৪৪৪তম বোম্বার্ডমেন্ট স্কোয়ার্ড এখান থেকে মায়ানমারের দিকে রওনা হয়েছিল। যুদ্ধের অনেক অভিযানই এখান থেকে করা হত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এভাবেই মার্কিন বিমান বাহিনীকে সাহায্য করেছিল ঝাড়গ্রামের রাজা। শুধু বিমান বাহিনী নয়, গরীব কৃষকদের প্রায় দশ হাজার বিঘা জমি বিলি করেছিলেন রাজা নরসিংহ দেব। এই দানশীল রাজা ভারত সেবাশ্রম সংঘ, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ, এমনকি নতুন দিল্লি কালীবাড়িকেও সাহায্য করেছেন প্রয়োজনে।

কলকাতা শহর থেকে NH-6 ধরে প্রায় ১৪০ কিলোমিটার দূরে ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ী। ১৯৩১ সালে কলকাতা উন্নয়ন সংস্থার উদ্যোগে ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ীর সংস্কার করা হয়েছিল। তারপর থেকে রীতিমতো টুরিস্ট স্পট এই অঞ্চল। রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় নিয়মিত। মানুষের ভিড়, ঝাঁ-চকচকে ব্যবস্থাপনা কোথাও যেন ইতিহাসের পরিপন্থী। তবুও ইতিহাসকে সংরক্ষণ করতে গেলে মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না।

 

JhargramRajbari1

ঝাড়গ্রাম প্রাচীন শহর। মুঘল সম্রাট আকবরের সমকালীন। রাজা মানসিংহ ছিলেন আকবরের সুবেদার। তাঁর সেনাপতি ছিলেন সর্বেশ্বর সিং। জঙ্গলখন্ড রাজ্যের মাল রাজাকে পরাস্ত করে এই সর্বেশ্বর সিং পুরো এলাকা দখল করেছিলেন। প্রসন্ন হয়ে মানসিং সর্বেশ্বর সিংকে জঙ্গলখন্ডের মনসবদারি প্রদান করেছিলেন। তারপর সর্বেশ্বর সিংয়ের দাদা এখানে রাজধানী স্থাপন করে জঙ্গল খন্ডের নামকরণ করেছিলেন ঝাড়গ্রাম হিসেবে। রাজপুত জাতির এই চৌহান বংশের রাজারা সম্রাট আকবরের কাছ থেকে 'মল্লদেব' উপাধি লাভ করেন।

রাজা নরসিংহ দেব মল্লর সময় কালকে বলা হতো চৌহানের রাজত্বের স্বর্ণযুগ। তার দেওয়ান দেবেন্দ্রমোহন ভট্টাচার্যের পরামর্শে তিনি ঝাড়গ্রামকে একটি আধুনিক শহরের যোগদান করেছিলেন। এই শহরের মধ্যমণি হিসেবে প্রায় তিরিশ একর জমির ওপর তিনি গড়ে তুলেছিলেন ইন্দো-সারাসেনিক স্থাপত্যের অন্যতম নিদর্শন এই ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ি। ১৭৯৯ সালের চুয়াড় বিদ্রোহের সঙ্গেও যোগ আছে এই রাজবাড়ীর। ১৯৩১ সালে কলকাতা উন্নয়ন সংস্থার উদ্যোগে সংস্কার করা হয় এই রাজবাড়ীর।

এই রাজবাড়ির বিশেষত্ব ইন্দো সারাসেনিক স্থাপত্য। সারা্সেনিক শব্দটি রোমানরা ব্যবহার করতেন আরবের মরুভূমিতে রোমান সাম্রাজ্যের বসবাসকারীদের লক্ষ্যে। মরুবাসী আরবদের থেকে আলাদা করার জন্যই এদের এমন নাম দেওয়া হয়েছিল। ইন্দোসারাসোনিক স্থাপত্যকে অনেকেই ইন্দো-ইসলামিক মুঘল স্থাপত্যের সঙ্গেও তুলনা করেন।

 

JhargramRajbari2

ঝাড়গ্রাম রাজবাড়িতে গম্বুজ এবং চক্রের সৌন্দর্য অন্যরকম। রাজবাড়ীতে প্রবেশের মূল দরজাটির গঠনেও আধুনিক স্থাপত্যের জৌলুসের ছাপ। এর দুদিকে চারটি করে মোট আটটি স্তম্ভের উপর দুটি বিশাল চক্র রয়েছে। রাজবাড়ীর মূল দরজাতেও গম্বুজ রয়েছে। আধুনিক ঝাড়গ্রামের রূপকার বলা হয় রাজা নরসিংহ দেব মল্লকে। এই রাজা চণ্ডীচরণ মল্লদেব' এবং কুমুদকুমারীর একমাত্র পুত্র। বাংলার গভর্নর বালক নরসিংহের দেখভালের জন্য দেবেন্দ্রমোহন ভট্টাচার্যকে পাঠিয়েছিলেন, কারণ অল্প বয়সেই তিনি বাবাকে হারান।

তারপর কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়াশোনা করেছিলেন নরসিংহ দেব। ইতিহাস বিষয়ে পন্ডিত ছিলেন। ‌ ১৯৩০ সালে রাজা নরসিংহদেব ময়ূরভঞ্জ নিবাসী বিনোদমঞ্জরী দেবীকে বিবাহ করেন। তাঁর পুত্র যুবরাজ বীরেন্দ্র বিজয় মল্লদেব এবং কন্যা রাজকুমারী সাবিত্রী দেবী। প্রথমা স্ত্রীর মৃত্যুর পর তিনি বিয়ে করেছিলেন রূপমঞ্জরী দেবীকে। তাঁদের দুই কন্যা, রাজকুমারী গায়ত্রী দেবী এবং জয়শ্রী দেবী। দানশীল এই রাজা ছিলেন ভালো শিকারী। অনেক পুরস্কার পেয়েছিলেন শিকারের ক্ষেত্রে, এসবই রাখা রয়েছে ঝাড়গ্রাম রাজবাড়িতে। লড়াই, ইতিহাস থেকে বর্তমানে টুরিস্ট স্পট হিসেবে আত্মপ্রকাশের পথ ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ি অতিক্রম করেছে তার ইতিহাসকে সঙ্গে করেই।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...