সময়টা সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ। ভারতবর্ষে মুঘল শাসনের সূর্য তখন অস্তমিত। তাদের শাসনকাল শেষের পথে। ভারতবর্ষে ধীরে ধীরে বিস্তার লাভ করছে ছত্রপতি শিবাজীর সাম্রাজ্য। বাংলাও এই মারাঠা-যোদ্ধার নজর এড়ায়নি। বাংলার নবাব তখন আলীবর্দী খাঁ। ১৭৪০ সাল থেকেই শান্ত বাংলায় প্রবেশ করা শুরু করে অশ্বারোহী মারাঠা যোদ্ধা বাহিনী। চলতে থাকে অবাধে লুঠপাট, অত্যাচার। এই মারাঠা যোদ্ধারাই বর্গী নামে পরিচিত। আলীবর্দী খাঁ দীর্ঘ লড়াই করে তাঁর রাজ্য রক্ষা করেছিলেন, তবে বর্গীদের আক্রমণ সম্পূর্ণরূপে ঠেকাতে পারেননি। এর ফলাফল ছিল সাংঘাতিক।
বাংলায় তখন দুর্ভিক্ষের অন্ধকার। এদিকে বর্গীরা নিজেদের খাজনা আদায়ের ব্যাপারে অনমনীয়। বাংলার রাজারা তখন হিমসিম খাচ্ছেন এই অবস্থা সামলাতে। একের পর এক রাজা নবাবের কাছে আর্জি জানাচ্ছেন পরিস্থিতি সামলানোর জন্য। কোণঠাসা হয়ে পড়লেন নবাব। মারাঠাদের সঙ্গে শান্তি-চুক্তিতে আবদ্ধ হলেন তিনি। তবে বাংলার মানুষের মনে বর্গীদের ত্রাস ছিল দীর্ঘদিন। এই সময় তৈরি হয়েছিল সেই ঘুম পাড়ানি গান,
"খোকা ঘুমোলো পাড়া জুড়োলো, বর্গী এলো দেশে,
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে,
খাজনা দেবো কিসে।"
তারপর সময় পাল্টাল নিজের নিয়মে। অত্যাচারী বর্গীদের মধ্যে কেউ কেউ ভালোবেসে ফেলেছিল এই সোনার বাংলাকে। নিজেদের ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করে বাংলায়। ধীরে ধীরে বাংলার মাটি, হাওয়া, জলকে আপন করে নেয় তারা। স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করে বিভিন্ন অঞ্চলে। এমনই এক বর্গীর হাতে তৈরি ইটাচুনা রাজবাড়ি।
ইটাচুনা রাজবাড়ির পূর্বপুরুষরা ছিলেন কুন্দন পদবীর অধিকারী। পরে এটাই বাঙালির অতি পরিচিত পদবী 'কুণ্ডুতে' পরিণত হয়। ইটাচুনা রাজবাড়ি তৈরি করেছিলেন সাফল্যনারায়ণ কুন্ডুর পূর্বপুরুষরা।
আনুমানিক ১৭৬৬ সালে এই রাজবাড়ি তৈরি হয়। সুদৃশ্য এই রাজবাড়ির পাঁচটি মহল সুসজ্জিত। একটা গ্রামসভা বা দরবার হল, অন্যটি নাচঘর বা জলসাঘর, একটি রন্ধনশালা , অতিথিশালা এবং মহিলাদের জন্য একটি অন্দরমহল রয়েছে এই রাজবাড়িতে। এখানে এখনও দেখা যায় কাঠের তৈরি নকশা করা প্রাচীন চেয়ার, পালঙ্ক, টেবিল। ইটাচুনা রাজবাড়িতে থাকার সুবন্দোবস্ত রয়েছে। তার জন্য আছে মোট ১৪টি ঘর। এছাড়াও সাদা পাথরের মেঝেওলা বিশাল নাটমন্দির ফিসফিস করে ইতিহাসের কথা শোনায়। এঁদের গৃহদেবতা শ্রীধর জিউ বা নারায়ণ। বছরে তিনবার সেই ঠাকুরের পুজো হয় এখনো।
সেই যে বাবার এক আহ্লাদী মেয়েকে মনে আছে? কৌতূহলী, মায়াবী চোখ নিয়ে ভিতরের বারান্দার একটা ছোট্ট জানলা খুলে চোখ রেখেছিল, জমিদার বাবার কাছে চাকরিপ্রার্থী ছেলেটার দিকে। প্রথম দর্শনেই প্রেম। চেনা চেনা লাগছে চিত্রনাট্যটা? 'লুটেরা' সিনেমা। শুটিং হয়েছিল এই ইটাচুনা রাজবাড়িতেই। এছাড়াও অন্য নানা সিনেমার শুটিংও হয়েছে এখানে। সপ্তাহান্তে ভ্রমণের ছোটখাটো একটা 'ট্যুরিস্ট স্পট' হিসেবেও বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে ইটাচুনা রাজবাড়ি। সাবেকি রাজবাড়িতে ভিতর-বাহির মহল আলাদা। বাড়ির লম্বা, নিঝুম অলিন্দ আর জানলা দিয়ে চোখ মেলে দেখা বাইরের সবুজের সমারোহ বড় মায়াবী, মন-কেমনের গন্ধমাখা।
এই রাজবাড়ির অন্যতম আকর্ষণ ছাদ। সুবিস্তৃত ছাদ আর আকাশের মেলবন্ধন বড় কাছ থেকে দেখা যায় এখানে। সন্ধ্যা-আরতির ঘণ্টাধ্বনি, হীরের টুকরো ছড়ানো নক্ষত্রের রাত ইটাচুনার গায়ে এখনো শহুরে গন্ধ লাগতে দেয়নি। নিত্য শহুরে অতিথি সামলেও গ্রাম্য, মেঠো গন্ধ লেগে রয়েছে। এক বাঁশি বাদক এখানে বাঁশি বাজাতে আসেন পাশের গ্রাম থেকে। এই রাজবাড়ির বিভিন্ন আসবাবপত্র, এমনকি ঝাড়বাতিও দর্শনীয়। আভিজাত্য মোড়া, অথচ ইতিহাসের গন্ধ মাখানো।
তবে ইটাচুনা রাজবাড়ির দেওয়ালে বর্গী হামলার স্মৃতি কোথাও যেন তার ছাপ ফেলে গেছে। সাধারণ মানুষের কাছে ইটাচুনা এখনো বর্গীডাঙা নামে পরিচিত। কেউ কেউ আবার বলে বর্গীবাড়ী। তাই এই রাজবাড়ি জুড়ে বাংলার ঐতিহ্যের, সংস্কৃতির মায়ার সঙ্গে মিশে রয়েছে অত্যাচারের স্মৃতি।