রাজবাড়ি পর্ব ৪ঃ হেতমপুর রাজবাড়ী

বোলপুর থেকে কয়েক কিলোমিটার পথ। খোয়াইয়ের ভিড় এড়িয়ে নিঃসঙ্গতার উদযাপন। হেতমপুর রাজবাড়ী রঞ্জন প্রাসাদ নামেও পরিচিত। খোলা মাঠের উপর লাল, হলুদ রং মিশিয়ে এই বিশাল প্রাসাদ অনেক ইতিহাসের সাক্ষী। রাজবাড়ির সুউচ্চ পিলার গল্প শোনায় ভাগ্যবদলের। স্থাপত্যের জন্য রঞ্জন প্রাসাদকে ‘টুইন প্যালেস’ও বলা হয়। হেতমপুর রাজবাড়ীর ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে রাজনগরের ইতিহাস।

একসময় হেতমপুরের নাম ছিল রাঘবপুর। রাজা রাঘব রায়ের নাম অনুসারে নামকরণ হয়েছিল অঞ্চলের। রাজনগর মূলত মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা ছিল। রাজনগরের রাজা আসাদুল্লাহ খানের মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে বাদিউজ্জামান খান রাজা হন।

তাঁর রাজত্বকালে তহসিলদারদের সঙ্গে প্রবল বিরোধিতা ছিল রাজত্ব চালানো এবং কর আদায়কে কেন্দ্র করে। পরিস্থিতি সামাল দিতে রাজনগরের সেনাপতি হেতম খানকে পাঠানো হয় রাঘবপুরে। বিচক্ষণতার সঙ্গে রাঘব রায়কে পরাজিত করে বিদ্রোহ দমন করেন হেতম খান। তখন বাদিউজ্জামান খুশি হয়ে ‘রাঘবপুর’ হেতম খানকে উপহার হিসেবে দেন। রাঘবপুর বদলে হয় হেতমপুর।

এদিকে রাঘব রায়ের মৃত্যুর পর রাজনগরে রাজার নায়েব হিসেবে নিযুক্ত হন তাঁর ছেলে। সেই থেকে রায় পরিবারের মানুষজন রাজনগরের জমিদারদের গোমস্তা ও ইজারাদার হিসেবে নিযুক্ত হতে থাকে।

এমন সময় মুরলীধর চক্রবর্তী নামে এক ব্যক্তি বাঁকুড়া থেকে এসেছিলেন কাজের খোঁজে, তিনি বাদিউজ্জামান-এর পরিবারের ভৃত্য হিসেবে নিযুক্ত হন। তাঁর উত্তরসূরি চৈতন্য চক্রবর্তীর গানে মুগ্ধ হয়ে বাদিউজ্জামানের উত্তরসূরী হাফেজ খান তাঁকে হেতমপুর দুর্গ দেখভালের দায়িত্ব দেন। চৈতন্য চক্রবর্তীর দ্বিতীয় পুত্র রাধানাথ ছিলেন বিচক্ষণ ও দূরদর্শী। রাধানাথ চক্রবর্তীর হাত ধরেই হেতমপুর রাজপরিবারের প্রতিষ্ঠা হয়।

ধীরে ধীরে পাল্টায় সময়। বাংলায় পলাশীর যুদ্ধের পর মুঘলদের বিদায় এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আধিপত্য শুরু হয়। সিউড়ি হয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হেড কোয়ার্টার। এদিকে রাধানাথ চক্রবর্তী ধীরে ধীরে হেতমপুরে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করেন। হাফেজ খানের পরিবারকে যুদ্ধে পরাস্ত করেন। রাধানাথের পৌত্র রামরঞ্জন চক্রবর্তী ১৯০৫ সালে স্থাপন করেছিলেন হেতমপুর রাজবাড়ী। রাজবাড়ীর প্রকাণ্ড দরজায় খোদিত রয়েছে ‘রঞ্জন প্রাসাদ’ নাম।

রাজা হিসেবে রামরঞ্জন চক্রবর্তী ছিলেন দয়ালু, বিচক্ষণ ও দূরদর্শী। ১৮৭৫ সালে গভর্নর জেনারেল লর্ড নর্থব্রুক তাঁকে রাজা উপাধি দিয়েছিলেন। লর্ড লিটন তাঁকে ‘রাজা বাহাদুর’ উপাধি দেন। ১৯২২ সালে ‘মহারাজা‘ উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন তিনি।

তাঁর অনন্য রুচিবোধে নির্মিত এই হেতমপুর রাজবাড়ীর নকশায় রয়েছে ইন্দো-ইউরোপীয় স্থাপত্যের মিশ্রন। ইউরোপিয়ান ধাঁচের প্রকাণ্ড দরজা মুগ্ধ করে। বাড়ির মূল প্রবেশের দু'ধারের স্থাপত্য যেন একে অপরের পরিপূরক। তাই একে যমজ রাজবাড়ীও বলা হয়।

গঠনের দিক দিয়ে মুর্শিদাবাদের হাজারদুয়ারির সঙ্গে অদ্ভুত মিল এই হেতমপুর রাজবাড়ীর। একে হেতমপুর হাজারদুয়ারিও বলা হয়। হাজারদুয়ারির সম্মান রক্ষার্থে হেতমপুর রাজবাড়িতে রাখা হয়েছিল ৯৯৯টি দরজা, একটি দরজার নির্মাণ করা হয়নি ইচ্ছে করেই। রাজপ্রাসাদ প্রায় এক হাজারেরও বেশি জায়গা জুড়ে তৈরি হয়েছিল।

‘বীরভূম রাজবংশ’ বইটি ১৩১৬ সালে হেতমপুর রাজবাড়ীর মহিমারঞ্জন চক্রবর্তীর লেখা। হেতমপুর রাজবাড়ীর এটি প্রথম লিখিত ইতিহাস। কথিত আছে বীরভূমে প্রাচীন হিন্দু রাজ্য ছিল এবং তাঁরা ছিলেন পরাক্রমী এবং বীর। তাঁরা নাকি সাঁওতাল যুদ্ধে সাঁওতাল বিদ্রোহীদের পরাজিত করেছিলেন, এমনকি বর্গী ও মারাঠা আক্রমণের মোকাবিলাও করেছিলেন।

হেতমপুর রাজপরিবারের সুনাম ছিল দাতা হিসেবে। এই পরিবারের নাবালক পুত্র রামরঞ্জনের দায়িত্ব নিয়েছিল ব্রিটিশ সরকার। পরবর্তীকালে তিনিই এই অঞ্চলে স্কুল, কলেজ, লাইব্রেরী, দাতব্য চিকিৎসালয় গড়ে দিয়েছিলেন গরিব মানুষের সেবা করার লক্ষ্যে। দুর্ভিক্ষের সময় প্রজাদের অকাতরে ত্রাণ বিলিয়েছিলেন।

বীরভূমের সামগ্রিক উন্নতির ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা ছিল হেতমপুর রাজপরিবারের। এই পরিবারের মহিমারঞ্জন চক্রবর্তী উদ্যোগে বীরভূমের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে ঘটেছিল পরিবর্তন। এই অঞ্চলের ঐতিহাসিক সুনাম অক্ষুন্ন রেখেছে এই রাজবাড়ী।

'গুপী গায়েন বাঘা বাইন' ছবির শুটিং হয়েছিল এই রাজবাড়ী এবং তার সংলগ্ন অঞ্চলে। সন্দীপ রায়ের ফেলুদা সিরিজের ‘গোঁসাইপুর সরগরম’ সিনেমার শুটিং হয়েছিল এই রাজবাড়ীতে। রাজবাড়ীর কিছু অংশে স্কুল এবং কলেজ তৈরি হয়েছে বর্তমানে। এই পরিবারের মানুষেরা কলকাতা এবং হেতমপুর দুই জায়গায় মিলেই বাস করেন বর্তমানে। ছন্দোবদ্ধ জীবন আমাদের, তবুও ইতিহাস অব্যক্ত কথা শোনায়, নিস্তরঙ্গ জীবনের গোপন তরঙ্গের খোঁজ দেয়।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...