পথ আর পথ। কিছুতেই শেষ হয় না। বাঁকুড়ার লাল মাটির সোঁদা গন্ধের টান ঠিক পথের মতই। অনন্তই যেন তার সীমা। এগিয়ে যেতে যেতেই অবশেষে আসে গন্তব্য। তবে সে নেহাত সাময়িক। গন্তব্যের পরে অপেক্ষায় থাকে আরও পথ। সে পথে হয়ত প্রতীক্ষার ডানা মেলে থাকে স্মৃতি, অতীত। ইতিহাস এমনই।
বাঁকুড়ার হদল-নারায়ণপুর রাজবাড়ি মন্দির বেষ্টিত। যদিও এটি জমিদারবাড়ি নাকি রাজবাড়ি তাই নিয়ে রয়েছে নানা বিতর্ক। তবে এই রাজবাড়ির মূল আকর্ষণ এই পরিবারের তৈরী মন্দির। রাজবাড়ির কারুকার্য যথেষ্ট সুন্দর। তবে চোখ ফেরানো যায় না এই রাজবাড়ির সঙ্গে যুক্ত থাকা মন্দির থেকে।
বাঁকুড়ায় তখন মল্লরাজাদের রাজত্ব চলছে। সময়কাল ১৭২০ থেকে ১৭৫২ সাল। গোপাল সিংহ ছিলেন সিংহাসনে। এমন সময় বর্ধমানের এক বর্ধিষ্ণু পরিবারের বংশধর মুচিরাম ঘোষ আসেন বাঁকুড়ায়। মুচিরাম ঘোষ বুদ্ধিমান, পণ্ডিত মানুষ ছিলেন। মল্লরাজা গোপাল সিংহের সভাসদ গণিতজ্ঞ শুভঙ্কর দাসের সঙ্গে আলাপ হয় মুচিরাম ঘোষের। শুভঙ্কর দাস মুচিরাম ঘোষের বিচক্ষণতায় মুগ্ধ হয়ে তাঁর আলাপ করিয়ে দেন রাজা গোপাল সিংহের সঙ্গে।
অল্প দিনেই রাজার মন জয় করে ফেলেছিলেন মুচিরাম ঘোষ। রাজা তাঁকে বাঁকুড়ার হদল-নারায়ণপুরের ফৌজদার হিসেবে নিযুক্ত করেন। পরবর্তীকালে তিনি মন্ডলপতি উপাধি লাভ করে নিজের জমিদারি বিস্তার করেন। নীলচাষ করেও আয় করেছিলেন অনেক।
পরিবারের সঙ্গে হদল-নারায়ণপুরেই থেকে যান মুচিরাম ঘোষ। সুবিশাল অট্টালিকা তৈরী করেছিলেন। পরবর্তীকালে বাঁকুড়ার হদল-নারায়ণপুর রাজবাড়ি হিসেবে পরিচিত হয় এই জমিদারবাড়ি।
টেরাকোটার মন্দির, রাসমঞ্চ গড়ে তুলেছিলেন মুচিরাম ঘোষ। তিনি পরবর্তীকালে মন্ডলপতি উপাধিতে ভূষিত হন। মুচিরাম ঘোষের পরিবার ‘মন্ডল পরিবার’ বলেই পরিচিত হয়েছে পরে।
মন্ডল পরিবারের দুটি প্রাসাদ আছে। বড় তরফ আর ছোট তরফ। বড় তরফের অট্টালিকা প্রকৃত অর্থে পুরা কীর্তি। এর বাইরে রয়েছে সতেরোটি চূড়া বিশিষ্ট দ্বিতল রাসমঞ্চ। এর উচ্চতা ৪০ ফুট, প্রতি দিকের দৈর্ঘ্য ৮ফুট ৩ ইঞ্চি। দেওয়ালে রয়েছে অপূর্ব ভাস্কর্য। অনন্তশয়নে বিষ্ণু, শিবের মূর্তি, গজলক্ষ্মী উল্লেখযোগ্য।
এছাড়াও রয়েছে দক্ষিণমুখী পঞ্চরত্ন মন্দির। গায়ে রয়েছে প্রতিষ্ঠালিপি। এছাড়াও রাধা-দামোদর মন্দির রয়েছে। সেখানে রয়েছে টেরাকোটার অলংকরণ।
মন্ডল পরিবারের ছোট তরফের প্রাসাদের সঙ্গেও রয়েছে দক্ষিণমুখী নবরত্ন মন্দির। এটি দেখতে গীর্জার মত। এখানেও রয়েছে টেরাকোটার কাজ।
এই রাজবাড়ি ও মন্দিরসমূহ মন্ডল পরিবারের লোকেরাই দেখাশোনা করেন। এভাবেই স্মৃতি বয়ে নিয়ে চলেছে বাঁকুড়ার এই রাজবাড়ি।