"ভাঙা গড় গড়াইব, জলপূর্ণ করি,
জলশূন্য পরিখায়, ধনুর্বান ধরি দ্বারিগণ,
আবার রক্ষীবে দ্বার অতি কুতূহলে।"
কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত ১৮৭২ সালে মহারাজা নীলমণি সিংদেওর রাজসভায় ম্যানেজার হয়ে গিয়েছিলেন। প্রথাগত চাকরি। তবুও গড় পঞ্চকোট-এর ইতিহাস তাঁকে আচ্ছন্ন করেছিল। গড়পঞ্চকোট পাদদেশের রাজধানী ভ্রমণের সময় তিনি পঞ্চকোট সম্পর্কে তিনটি সনেট রচনা করেছিলেন। 'পঞ্চকোট গিরি', 'পঞ্চকোট রাজশ্রী', 'পঞ্চকোট গিরি বিদায় সংগীত'। মাইকেলের স্বপ্ন ছিল পঞ্চকোট সংস্কার করা। এই সনেটে তাঁর সেই ইচ্ছে ধরা পড়ে। যদিও সেই সংস্কার সেভাবে হয়নি। তবে তাঁর এই সনেটের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যে স্থায়ী আসন পেয়েছিল গড় পঞ্চকোট।
কথিত আছে, রাজপুত্র দামোদর শেখর পঞ্চকোট অর্থাৎ শিখরভূম রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পুরুলিয়ার ঝালদায় প্রথম পত্তন হয় এই রাজপরিবারের। এই রাজপরিবার রাজধানী বদল করেছে সাতবার। ঝালদা, পাড়া, পঞ্চকোট পাহাড়ের পাদদেশ, মহারাজনগর রামবনি, কেশরগড় এবং সর্বশেষ কাশীপুর। কাশীপুরের রাজবাড়িটি মোটামুটি অক্ষত রয়েছে। একই বংশের একাশিজন রাজপুরুষ সিংহাসনে বসেছেন এবং প্রায় দুই হাজার বছর ধরে রাজত্ব করেছেন এই রাজবংশ। এমন ঘটনা ইতিহাসে বিরল।
ফিরে আসি গড়পঞ্চকোটের কথায়। রাজা কীর্তিনাথ শেখর ৯২৬ খ্রিস্টাব্দে পাড়া গ্রাম থেকে পঞ্চকোটে রাজধানী স্থানান্তরিত করেছিলেন। এই অঞ্চলে রাজধানী ছিল প্রায় আটশ বছর। ১৭৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। আসানসোল-পুরুলিয়া রোডের ওপর আসানসোল থেকে প্রায় তিরিশ কিলোমিটার দূরত্বে গোবাগ মোড়। সেই মোড় সংলগ্ন গড়পঞ্চকোট গ্রাম। এর নিকটবর্তী রেলস্টেশন রামকানালি। এই রাজধানীর উত্তরে পঞ্চকোট পাহাড়, দক্ষিণে জলপূর্ণ পাঁচটি পরিখা ছিল। এছাড়াও রাজধানী এলাকায় দশটি পুকুর, প্রবেশপথে চারটি তোরণদুয়ার বাঁধ এই অঞ্চলকে সুরক্ষিত রাখত।
পাহাড়ের পাদদেশে ছিল রাজপরিবারের মূল বাসভূমি অর্থাৎ রানীমহল আর মন্দির ক্ষেত্র। তবে এই পাহাড়ের পাঁচশো ফুট ওপরে মূল দুর্গ ছিল যার মধ্যে রাজ পরিবার বসবাস করত। রাজকর্মচারীদের থাকার ব্যবস্থা ছিল এই দুর্গেই। পাহাড়ের ওপরে ছিল রঘুনাথ মন্দির। পঞ্চকোট পাহাড়ের পাদদেশে রাজার অন্দরমহলে রানীমহল-এর ধ্বংসাবশেষ আজও বর্তমান।
গড়পঞ্চকোটকে নিঃসন্দেহে মন্দিরভূমি বলা যেতে পারে। এই রানি মহলের চারপাশে বিশাল মন্দির ক্ষেত্র ছিল। শোনা যায় সংলগ্ন অঞ্চলে প্রায় ১৪টি মন্দির ছিল। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল পঞ্চরত্ন মন্দির। পঞ্চকোট পাহাড়-এর তলদেশে এই মন্দিরটি এখনও পর্যটকদের আকর্ষণের মূল কেন্দ্র। মন্দিরটির সংস্কারও সমাপ্ত হয়েছে সম্প্রতি।
মাইথনের কল্যাণেশ্বরী মন্দির আগে এই গড়পঞ্চকোট মন্দিরক্ষেত্রের অংশ ছিল। ২০০২ সালে এর ধ্বংসাবশেষ মাটির নীচ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। রাজা কলযাণশেখর ছিলেন এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা।
গড়পঞ্চকোট-এর মূল দুর্গের অর্থাৎ রাজধানীর পতনের কাহিনী ইতিহাসের এক অনন্য অধ্যায়। ১৭৪১ সাল থেকে দীর্ঘ এক দশক ধরে বারবার মারাঠা বর্গীদের আক্রমণে গড়পঞ্চকোট দুর্গ দুর্বল হয়ে পড়েছিল। কিন্তু দুর্গের পতনের প্রকৃত কারণ ছিল পারিবারিক অন্তর্কলহ। ষড়যন্ত্র। অস্থিরতা, মানসিক দ্বেষ।
এই দুর্গের শেষ রাজা নাবালক মণিলাল পিতৃহারা হয় মাত্র সাত বছর বয়সে। তখন তার খুড়তুতো ভাইরা রাজপরিবারের দখল নিতে উদ্যত হয়। ফলস্বরূপ মণিলালের দাদু গোপালদেও খুন হয় এবং তার মামা লালদেওকে তাড়িয়ে দেওয়া হয় গড়পঞ্চকোট থেকে। এদিকে নিজের বাবার হত্যার প্রতিশোধস্পৃহার আগুনে জ্বলতে থাকে লালদেও। কিন্তু সহজ ছিল না প্রতিআক্রমণ। লালদেও তখন নিজের দল তৈরি করতে থাকে। এক রাতে লালদেও একদল দস্যু নিয়ে গড়পঞ্চকোটে প্রবেশ করে নারী-শিশু, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা সকলকে হত্যা করে। এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে নাবালক রাজাকে বাঁচায় এক রাজকর্মচারী-শোভারাম বন্দ্যোপাধ্যায়। তার তত্ত্বাবধানে ছোট রাজা মণিলালকে রাখা হয়েছিল এক গ্রামে। বয়স কম হলেও মণিলাল ছিলেন প্রজাবৎসল। প্রজাদের উন্নতি সাধনের লক্ষ্য ছিল তাঁর। পরে মনিলালকে মহারাজনগরে নিয়ে আসে প্রজারা। এখানে স্থাপিত হয় নতুন রাজধানী। গড় পঞ্চকোট-এর এই দুর্গ, রানিমহল রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত। তবু ইতিহাসে এই রাজপরিবারের নাম উজ্জ্বল। এই রাজপরিবার প্রজাবৎসল ছিলেন। প্রজাতির উন্নতিসাধন ছিল তাঁদের মূল লক্ষ্য। তাই এই রাজপরিবার ইতিহাসের পাতায় স্বমহিমায় উজ্জ্বল।