সময়টা ১৭৯৩ সাল। তখন অবিভক্ত বাংলাদেশ। নওগাঁ শহর। রাজা কৃষ্ণনাথ রায় পৌঁছলেন লর্ড কর্নওয়ালিসের কাছে। একটু একটু করে ব্রিটিশরা ঘাঁটি তৈরি করতে শুরু করেছে এই দেশে। কোনও রাজাই নিশ্চিন্ত থাকতে পারছেন না তখন। লড়াই করার তেমন প্রস্তুতি সে সময় ছিল না। রাজারা তখন মূলত সমঝোতার মাধ্যমে ব্রিটিশদের কাছ থেকে নিজেদের রাজ্য চালানোর সম্মতি আদায়ে ব্যস্ত। নওগাঁ শহর ছিল দুবলহাটি রাজ্যের অন্তর্গত।
রাজা কৃষ্ণনাথ রায় দুবলহাটি সাম্রাজ্য বাঁচানোর চেষ্টায় মরিয়া। কর্নওয়ালিসের কাছ থেকে তিনি ১৪ লাখ ৪৯৫ টাকা দিয়ে রাজ্য পরিচালনা করার দায়িত্ব পেলেন। শোনা যায় রাজা ছিলেন প্রজাবৎসল। প্রজাদের জন্য অনেক সংস্কার শুরু করেছিলেন তিনি। এমনকি স্কুল গড়ার পরিকল্পনাও শুরু করেছিলেন। তবে রাজা কৃষ্ণনাথ রায় ছিলেন নিঃসন্তান। এদিকে ধীরে ধীরে ভারতবর্ষ তথা অবিভক্ত বাংলাদেশে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বিস্তার শুরু হয়ে গেছে। রাজা কৃষ্ণনাথ রায় চিন্তিত থাকতেন তাঁর পরবর্তী সময়ে প্রজাদের অবস্থার কথা ভেবে। বাৎসল্যে আগলে রাখা প্রজাদের কথা চিন্তা করে তিনি ডেকে পাঠালেন তাঁর এক দুঃসম্পর্কের নাতিকে। শিক্ষিত, বুদ্ধিমান, সহানুভূতিশীল এই নাতি যে দুবলহাটি সাম্রাজ্যকে ভবিষ্যতে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে পারবেন এমন বিশ্বাস ছিল রাজা কৃষ্ণনাথ রায়ের।
অবশেষে ১৮৫৩ সালে দুবলহাটির রাজ্যভার গ্রহণ করেন রাজা কৃষ্ণনাথ রায়ের দুঃসম্পর্কের নাতি হরনাথ যায়। প্রকৃত অর্থেই দাদুর পদাঙ্ক অনুসরণ করেছিলেন হরনাথ রায়। রাজা হরনাথের রায়ের আমলে দুবলহাটি রাজ্যের ব্যাপক বিস্তার ঘটে। দুবলহাটি রাজবাড়িকে রুচিশীলতায় সাজিয়ে তুলেছিলেন রাজা হরনাথ রায়। রাজপ্রাসাদের অনেক স্থাপত্যই রাজা হরনাথ রায়ের আমলে নির্মিত।
রাধাকৃষ্ণ নাথ রায়ের মৃত্যুর পরও প্রজাদের অন্তরে তাঁর স্থান ছিল চিরদিন। শোনা যায় রাজা কৃষ্ণনাথ রায়ের কার্যকলাপের কথা মুখে মুখে ফিরত সেই সময়। এদিকে রাজা হরনাথ রায়ও সারাক্ষণ চিন্তা করতেন প্রজাদের উন্নতি সাধনের। সেই উন্নতি সাধনের প্রথম ধাপ হিসেবে হরনাথ রায় বেছে নিয়েছিলেন নিজের দাদুর পথ। দাদুর পরিকল্পনাকেই বাস্তবের রূপ দেন তিনি। ১৮৬৪ সালে তৎকালীন দুবলহাটি রাজ্যে প্রথমবার স্কুল স্থাপিত হয়। পরে স্কুলটির নামকরন করা হয় রাজা হরনাথ উচ্চ বিদ্যালয়।
এছাড়াও সেই সময়ে পানীয় জলের কষ্ট ছিল ওই অঞ্চলে। রাজা হরনাথ রায় রাজপ্রাসাদের আশেপাশে এলাকা জুড়ে গড়ে তোলেন অনেকগুলি পুকুর। শুধু নিত্যপ্রয়োজনীয় সুবিধা নয়, রাজা হরনাথ রায় প্রজাদের মনোরঞ্জনের জন্য গড়ে তুলেছিলেন নাট্যশালা। রাজা, মন্ত্রী ছাড়াও প্রজারাও সমাদৃত হতেন এই নাট্যশালায়। তাঁর কাজকর্মের জন্য হরনাথ রায় চৌধুরী ‘রাজা’ উপাধি পেয়েছিলেন।
দুবলহাটি রাজবাড়ির সঙ্গে যেমন একাধারে যুক্ত ছিল রাজাদের জীবন তেমনি এই রাজবাড়ির সঙ্গে যুক্ত ছিল জমিদারি প্রথা। মোঘলরা দুবলহাটি রাজ্যের রাজাদের জমিদার হিসেবে চিহ্নিত করেন। জমিদারি পরিচালনার ক্ষেত্রে তাঁদের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য।
দুবলহাটি রাজবাড়ি নওগাঁ শহর থেকে প্রায় ৬ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত। সুবিশাল অট্টালিকা সম্বলিত এই রাজবাড়ি। রাজবাড়ির মূল দরজায় রোমান স্থাপত্যের স্তম্ভ। মোট সাতটি উঠোন ও প্রায় তিনশত ঘর ছিল একসময় এই রাজবাড়িতে। রাজপ্রাসাদের ভেতরে সুন্দর কারুকার্য করা ভবনগুলো কোনটা তিনতলা কোনটি চারতলা।
রাজবাড়িতে এখনও শান-বাঁধানো একটি কুয়ো রয়েছে। রাজা হরনাথ রায় একটি বিশেষ পুকুর খনন করেছিলেন রাজবাড়ির সামনে। এটির নাম গোবিন্দ পুকুর। এই পুকুরের পাশেই নানান সাংস্কৃতিক চর্চার জন্য দুবলহাটির রাজা নির্মাণ করিয়েছিলেন ‘গান বাড়ি’ নামে একটি ভবন। এই গান বাড়ি কেবলমাত্র রাজার মনোরঞ্জনের লক্ষ্যেই তৈরি করা হয়েছিল।
গান বাড়ি থেকে দূরেই এই রাজপরিবারের কালী মন্দির। সংরক্ষণের অভাবে আগাছায় পরিপূর্ণ এই কালীমন্দির। কালী মন্দিরের কিছু দূরে রাজার বাগান বাড়ি। বিস্তৃত এলাকা জুড়ে গড়ে ওঠা দুবলহাটি রাজবাড়ি এমনভাবেই স্মৃতির ডানা বিস্তার করে রয়েছে দীর্ঘ অঞ্চল জুড়ে। এই রাজবাড়ি আজ ধ্বংসাবশেষে পরিণত।
১৯৫০ সালে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হওয়ার পর রাজা হরনাথ রায় ভারতে চলে গিয়েছিলেন। পরে ভারতবর্ষে পাকাপাকিভাবে বসবাস করতেন তিনি। এমনকি তাঁর কোন উত্তরসূরিও কখনো আর রাজবাড়িতে ফিরে যায়নি।
জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হওয়ার পরে বাংলাদেশ সরকার এই রাজবাড়িকে সরকারি সম্পদ হিসেবে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধীনে নিয়েছিল। কিন্তু এখনো পর্যন্ত কোনো সংস্কার আলাদা করে হয়নি এই রাজবাড়ির। দুবলহাটি রাজপ্রাসাদের মূলত দুটি ভবন। দুটি ভবনই সংস্কারের অভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। যদিও এই অঞ্চলে গেলে আজও ইতিহাসের ফিসফিসানি শোনা যায়। ইতিহাস, স্মৃতির সেসব অব্যক্ত কথা পাক খেতে থাকে দুবলহাটি রাজবাড়িতে।