রাজবাড়ি পর্ব ১৯ঃ দিনাজপুর রাজবাড়ি

আয়নামহল, রানীমহল, মন্দির, পুষ্করিণী। এই সব ঘিরেই ইতিহাসের সোঁদা গন্ধ। নানা জনশ্রুতি কথিত আছে এই রাজবাড়ি নিয়ে। মূল শহর থেকে প্রায় চার কিলোমিটার দূরে রাজবাড়ি। পথে শুধুই অতীতের কথা। তবে প্রমাণ নেই কিছুরই। সংরক্ষণের অভাবে এই রাজবাড়ির অবস্থা সঙ্গিন। ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রায়। এ অবস্থা বর্তমানের। অবহেলা, উপেক্ষা সবকিছুই বাংলাদেশের দিনাজপুরের ঐতিহ্যকে মলিন করেছে। হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসের গায়ে এঁকে দিয়েছে আরও হারিয়ে ফেলার ছবি।

এই রাজবাড়ির প্রাচীনত্ব নিয়েও রয়েছে নানা মতবাদ। তবে সাধারণত মনে করা হয় ষোড়শ শতাব্দীর রাজবাড়ি এটি। আনুমানিক ১৬০০ থেকে ১৬৫০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তৈরী হয়েছিল মধ্যযুগীয় স্থাপত্যশৈলীতে সমৃদ্ধ এই দিনাজপুর রাজবাড়ি। তেমন তথ্যের ভাণ্ডার নেই রাজবাড়ির সঙ্গে। তাই রাজবাড়ির প্রতিষ্ঠা নিয়েও রয়েছে নানা মতবাদ। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে ভারতের বহু পুরনো স্থানের মাটির সঙ্গে সাদৃশ্য পাওয়া যায় এই দিনাজপুরের মাটির। তাই অনুমান করে নেওয়া হয় ষোড়শ শতকের কথা।

বাংলাদেশের রাজারামপুর গ্রামের কাছে অবস্থিত দিনাজপুর রাজবাড়ি। স্থানীয় মানুষের কাছে 'রাজ বাটিকা' নামে পরিচিত।দিনাজপুর সংক্রান্ত একটি মুখপত্রে ঐতিহাসিকরা এই রাজবাড়ির স্থাপত্য নিয়ে নিজেদের অভিমত প্রকাশ করেছেন। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকাতেও এই রাজবাড়ির কথা উল্লেখ রয়েছে।

কবি ঘনশ্যাম মিত্র 'দিনাজপুর রাজ' কবিতায় লিখেছেন

''ত্রিবিক্রম সুতবর মধ্যে দিগম্বর।

তস্য পুত্র চক্রপাণি পুত গোপাল গণি।

বল্লভ তনয় তার কংসারি সংসারে যার।

কক্ষা মধ্যে কুলাই গণি, বল্লভ হইতে তানি।''

বল্লব ঘোষের ন'টি পুত্র ছিল। কংসারি ঘোষ ছিলেন অষ্টম। নিজের ভাগ্যের সন্ধানে কংসারি ঘোষের ছেলে কমল নয়ন ঘোষ বর্তমান পূর্ব বর্ধমান জেলার কুড়িগ্রাম থেকে ষোড়শ শতকের প্রথম দিকে দিনাজপুরে চলে গিয়েছিলেন। দিনাজপুর রাজ মহারাজা প্রাণনাথ রায় প্রতিষ্ঠিত এই মূল রাজবাড়ি। রাজপ্রাসাদের চারদিকে প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। প্রায় ১০ একর জমির ওপর এই রাজবাড়ির অবস্থান। রাজপ্রাসাদের মূলত দুটি অংশ। আয়নামহল ও রানীমহল। তবে সংযোগ নেই দুটি মহলের মধ্যে। একটি বিশাল পাঁচিল দিয়ে ঘেরা অংশ আলাদা করেছে এই দুটি মহলকে।

মহারাজ প্রাণনাথ ছিলেন সন্তানহীন। তাঁর দত্তক পুত্র ছিলেন রাজা রামনাথ। দিনাজপুর রাজবাড়ির বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন রাজার আমলে তৈরি হয়েছে। যেমন রানীমহল তৈরি হয়েছিল মহারাজা রামনাথ-এর আমলে। তবেই এই রানীমহল বর্তমানে ভগ্নস্তূপে পরিণত হয়েছে।

Dinajpur-Rajbari

আয়নামহলের স্থাপত্য-শৈলী মধ্যযুগের। দিনাজপুর রাজবাড়ি  কে ইতিহাসের স্থাপত্যশৈলীর বিষয়ে অনন্য আখ্যা পাওয়ানোর ক্ষেত্রে এই আয়না মহল-এর ভূমিকা সবচেয়ে বেশী। মহলটি দ্বিতল। কক্ষের সংখ্যা অনেক। এর সঙ্গে ছিল সভাকক্ষ আয়নামহলের নীচের অংশে এখনও রয়েছে বিরাট পাঠাগার। পাঠাগার সংলগ্ন সিঁড়ি। এই সিঁড়ির সঙ্গে আবার বিরাট জলাশয় যুক্ত ছিল। রাজার কুমির পোষা থাকত এখানে।

এছাড়াও দিনাজপুর রাজপ্রাসাদের একটি সদর মহল ছিল। সদর মহলটি ছিল অতি সুন্দর। মনোগ্রাহী কারুকার্য। দিনাজপুর রাজবাড়ির সঙ্গে যুক্ত রয়েছে বিরাট উঠোন ও রঙিন ফুলের বাগান।

দিনাজপুর রাজবাড়ির অন্যতম বিশেষত্ব এই রাজবাড়ি  র রাজাদের বিভিন্ন খেলার প্রতি আগ্রহ। খুব কম রাজবাড়ির সঙ্গেই নির্দিষ্ট খেলার ক্রীড়াস্থল রয়েছে। দিনাজপুর রাজবাড়ির সঙ্গে যুক্ত ছিল টেনিস কোর্ট। রাজা কুমার আগ্রহী ছিলেন টেনিস খেলার প্রতি। তাঁর উদ্যোগেই তৈরি হয়েছিল এই টেনিস কোর্ট। ‌ রাজা কুমারের নামে একটি নির্দিষ্ট মহল ছিল এই রাজবাড়িতে।

তবে দিনাজপুর রাজবাড়ির মূল বিতর্কের জায়গাটা হল এই রাজবাড়ির পত্তন।শোনা যায় শুরুর দিকে এই রাজবাড়ি এমন অবয়বের ছিল না। ধীরে ধীরে রাজবাড়ি গড়ে ওঠে তিলোত্তমা হিসেবে। প্রত্যেক বংশধর নিজের মত করে সাজিয়েছিল রাজবাড়ি। এই রাজবাড়ি সংলগ্ন ঠাকুরবাড়ি,  কালিয়া জিউ মন্দির স্থাপত্যের নিদর্শন রেখেছিল।

১৯৫১ সালে জমিদারি অধিগ্রহণ এবং প্রজাস্বত্ব আইন বাস্তবায়নের ফলে জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ হয়। এই রাজপরিবারের সর্বশেষ জমিদার জগদীশনাথ ১৯৬২ সালে কলকাতায় মারা যান। জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের পর একপ্রকার পরিত্যক্ত হতে থাকে এই রাজবাড়ি। ধীরে ধীরে ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়েছে এই রাজবাড়ির বিভিন্ন মহল। বাংলাদেশের রংপুর বিভাগের অন্তর্ভুক্ত এই দিনাজপুর। গ্রামের পথে পথে স্মৃতির পাথর ছড়িয়ে থাকা দিনাজপুর রাজবাড়ি টিকে রয়েছে আজও। তবে নেহাতই স্মৃতি-বিন্দু হিসেবে।                                                                                          

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...