হুগলি, পদ্মা ও জলঙ্গী নদী। এই তিন নদীর মধ্যে অবস্থিত এক শহর। ত্রিভুজাকৃতি এই শহরকে ইংরেজদের দলিলপত্রে দেখানো হয়েছিল দ্বীপ হিসেবে। নাম কাশিমবাজার দ্বীপ। এমনকি ঊনবিংশ শতকের শুরুর দিকে হুগলি নদীকেও কাশিমবাজার নদী হিসেবে বর্ণনা করা হত। ১৬৫৮ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একটি ইংরেজ এজেন্সি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল কাশিমবাজার শহরে। দুটি বাণিজ্য কুঠিও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ইংরেজরা এখানে।
কিন্তু ছবিটা বদলে গেল ১৮৯৩ সালে। এই ছবি বদলানোর শুরুটা হয়েছিল ১৮১১ সাল থেকেই। কাশিমবাজার সেই সময় বিখ্যাত ছিল রেশমশিল্পের জন্য। এমনকি হাতির দাঁতের সুন্দর কাজ হত এখানে। এই অঞ্চলের বালুচরি শাড়ি পৃথিবী বিখ্যাত ছিল। এমন এক সমৃদ্ধ শহর বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অনেকটাই নির্ভরশীল ছিল হুগলি নদীর ওপর। এদিকে হুগলি নদী তখন 'মন' বদলাচ্ছে। হুগলি নদীর গতিপথ পরিবর্তিত হল। কাশিমবাজার শহরের বাণিজ্য তখন অত্যন্ত ভাল অবস্থায় ছিল। কিন্তু হুগলি নদীর গতিপথ পরিবর্তিত হওয়ায় সমূহ ক্ষতি হলো বাণিজ্যের। তাই কাশিমবাজার শহরটি কোথাও যেন তার নিজের সেই ঝলমলে অস্তিত্ব হারালো।
এদিকে মারাঠা দস্যুদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে মুর্শিদাবাদের ভগবানগোলার পিরোজপুর থেকে বহরমপুর কাশিমবাজারে চলে এসেছিলেন সেই সময় কাশিমবাজারের রাজারা। শহরের পূর্ব মর্যাদা হারালেও এই শহরের রাজবাড়ি আজও বর্ণময় করে রেখেছে ইতিহাসে কাশিমবাজারের অস্তিত্ব। সেই সময় কাশিমবাজারের রাজা ছিলেন রাজা কৃষ্ণকান্ত নন্দী। কৃষ্ণকান্ত নন্দী ইংরেজ কুঠিতে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস সরবরাহ করতেন নিজের গুদাম থেকে। তাঁর নিজের এই বন্টন ব্যবস্থা তাঁকে কাছাকাছি এনে দেয় ইংরেজদের। ‘কান্ত মুদি’ নামে পরিচিত ছিলেন তিনি।
শোনা যায়, নবাব সিরাজদৌলা যখন ইংরেজ কুঠি আক্রমণ করেন তখন কৃষ্ণকান্ত নন্দী ওয়ারেন হেস্টিংসকে তাঁর রাজবাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিলেন এবং গোপনে পালিয়ে যেতেও সাহায্য করেছিলেন। পরবর্তীকালে এই ওয়ারেন হেস্টিংস বাংলার গভর্নর জেনারেল হন। রাজার আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়েছিলেন ওয়ারেন হেস্টিংস। তিনি কৃষ্ণকান্ত নন্দীর ছেলে লোকনাথ রায়কে রায়বাহাদুর খেতাব দেওয়ার সুপারিশ করেছিলেন।
এই লোকনাথ রায় ইংরেজদের সহায়তায় কাশিমবাজারের বিশাল জমিদারি লাভ করেন। মহারাজা কৃষ্ণকান্ত নন্দী তৈরি করেছিলেন কাশিমবাজারের রাজবাড়ি। তাঁকে সাহায্য করেছিলেন তাঁর পুত্র লোকনাথ রায়বাহাদুর। যদিও পরিচর্যার অভাবে বড় রাজবাড়ি আজ আর আগের গরিমায় নেই। তবে এই রাজবাড়ির সামনে দাঁড়ালে ইতিহাস তার নিজস্ব ভঙ্গিমায় ফিসফিসিয়ে বলে নানান অজানা কাহিনী।
কাশিমবাজারে বড় রাজবাড়ি ছাড়াও রয়েছে ছোট রাজবাড়ি। দুটি রাজবাড়িই ইউরোপীয় ও ভারতীয় স্থাপত্যের মিশ্রণে তৈরি। শোনা যায়, ছোট রাজবাড়ির কিছু অংশ বেনারসের মহারাজা চৈত সিংহের প্রাসাদ থেকে আনা বিশেষ পাথর দিয়ে খোদাই করা। কাশিমবাজার রাজবাড়ির মূল আকর্ষণ তার অন্দরমহল।
ঐতিহ্যবাহী কারুকার্য অন্দরমহল আর বাহিরমহলের তফাৎ স্পষ্ট করে। ছোট রাজবাড়ির রাজপ্রাসাদটি এখন মিউজিয়াম। গেস্ট হাউজ এবং বাতানুকূল রেস্টুরেন্ট সমেত রীতিমত উইকেন্ড টুরিস্ট স্পট। রাজবাড়ির অন্দরমহলের নাচমহল, শয়নকক্ষ, পালঙ্ক পুরনো দিনের গন্ধ মাখানো। রাজবাড়িতে অতিথিশালা, পুকুর, দুর্গা মন্ডপ ঐতিহ্যবাহী।
এই রাজবাড়ির দুর্গাপুজো প্রায় আড়াইশ বছরের পুরনো। প্রাচীন ঐতিহ্য মেনেই পুজো হয় এখানে। কাঠামো পুজো হয় রথের দিন। বংশপরম্পরায় মৃৎশিল্পীরা দেবী প্রতিমা তৈরি করেন। কুমারী পুজো হয় সপ্তমী থেকে নবমী। রাজবাড়ির মহিলারাই সাধারণত এই কুমারী পুজো করে থাকেন। সপ্তমী থেকে নবমী বিশেষ ভোগ নিবেদন করা হয় দেবীপ্রতিমাকে।
এই ভোগকে বলে বাল্যভোগ। নবমীতে হয় পংক্তি ভোজন। দুর্গাপুজোর সময় ভোগ বিতরণ করা হয় সাধারণ মানুষের মধ্যে। রাজবাড়ির পুজো কাশিমবাজার অঞ্চলে বিখ্যাত। ইতিহাস জীবিত রয়েছে সাধারণ মানুষের মধ্যেই, তাঁদের কথায়, কল্পনায়। এখনো পুজোর সময় মানুষের ঢল নামে রাজবাড়িতে। এভাবেই ইতিহাস স্মৃতির কবরে প্রোথিত হলেও বেঁচে থাকে মানুষের জনশ্রুতিতে, তাঁদের কথায়। এসব সাক্ষ্য বহন করে চলে রাজবাড়ি।