বাংলায় তখন রাজত্ব করছিলেন পাল রাজারা। পাল বংশের শেষ রাজা ছিলেন দেবপাল। দেবপাল মারা যাবার পর এক প্রকার বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছিল বাংলায়। এদিকে মোঘলরাও রাজত্ব করছে। একটু একটু করে বাংলায় আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করছিলেন মুঘল সম্রাটরা। বাংলায় তখন ছোট ছোট বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তির উত্থান হয়। এই ক্ষেত্রে মোট বারোজন জমিদারের নাম পাওয়া যায় ইতিহাসে। এদের বলে বারো ভূঁইয়া। এই বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিদের মধ্যে কোচ নামের একটি জনগোষ্ঠীর উদ্ভব হয় সে সময়।
আদিবাসী এই জনগোষ্ঠীর নেতা ছিলেন পরাক্রমী বীর। এই বারোভূঁইয়াদের সঙ্গেও যুদ্ধ করেছিলেন এই কোচ জনগোষ্ঠীর নেতা হারি আদরের সন্তান বিশু। তিনি সমগ্র কামতা রাজ্য নিজের দখলে নিয়ে আসতে পেরেছিলেন। শোনা যায় এই নেতাকে সকলেই তখন ভগবানের মতো মানতে শুরু করে। ভরসা করতে শুরু করেন মানুষজন।
১৫১৫ সালে বিশ্ব সিংহ উপাধি নিয়ে কোচ রাজ্য তৈরি করেছিলেন এই জনগোষ্ঠীর নেতা। কোচবিহারজেলার শুরুর কাহিনীটা এমনই। বিশ্ব সিংহ কোচ রাজ্যকে সন্তানের মতো আগলে রেখেছিলেন। রাজা হিসেবে প্রজাবৎসল ছিলেন তিনি। কোচ রাজ্যের শুরুর দিকের উন্নতি মূলত ছিল তাঁরই অবদান। পাকাপাকিভাবে এই রাজ্যে বসবাস শুরু করেছিলেন তিনি। কোচবিহারের মূল উন্নতিসাধন হয়েছিল এই বিশ্ব সিংহের হাত ধরে।
প্রজারা অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন তাঁকে। রাজা হিসেবে মেনে নিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে বিশ্ব সিংহ নারায়ণ উপাধি গ্রহণ করেছিলেন প্রজাদের ইচ্ছেতে। বংশ-পরম্পরায় তাঁরা রাজত্ব করেছেন কোচবিহারে। ১৯৫০ সালে জেলা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল কোচবিহার।
এই বিশ্ব সিংহের হাত ধরেই হয়েছিল কোচবিহার রাজবাড়ির পত্তন। বর্তমানে যদিও মূল রাজবাড়িটি কোচবিহারের মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণের তৈরি। বর্তমানের কোচবিহার রাজবাড়ি তৈরি হয়েছিল ১৮৮৭ সালে। বিখ্যাত আর্কিটেক্ট কোম্পানি মার্টিন এন্ড বার্ণ তৈরি করেছিল এই রাজবাড়ি। লন্ডনের বাকিংহাম প্যালেসের এর আদলে রাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণ এই রাজবাড়িটি নির্মাণ করিয়েছিলেন। মূলত ইউরোপিয়ান স্টাইল অনুসরণ করে তৈরি হয়েছিল রাজবাড়ির নানা নকশা।
বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে রাজবাড়িটির দরজার একদিকে সিংহ ও একদিকে হাতি। বাগান ও লেক ঘিরে লাল সাদা রঙের মনোরম দৃশ্যায়ন করা রাজবাড়ি। প্রথমে এই রাজবাড়ির নাম ছিল ভিক্টর জুবিলি প্যালেস। সময়ের স্রোতে ভেসে গেছে ইংরেজদের দেওয়া সেই নাম। বর্তমানে কোচবিহার রাজবাড়ি নামে পরিচিত। মোট পঞ্চাশটি ঘর রয়েছে এখানে। এই রাজবাড়ির একটি অংশকে জাদুঘরে রূপান্তরিত করা হয়েছে। পুরনো দিনের ব্যবহার করা তৈলচিত্র, ঝাড়বাতি, পোড়ামাটির মূর্তি, ভাস্কর্য সবকিছুই রাখা রয়েছে দর্শনার্থীদের জন্য।
গায়ত্রী দেবী কোচবিহার রাজ বংশের মেয়ে ছিলেন। কোচবিহার জেলার উন্নতি সাধন হয়েছিল এই বিশ্ব সিংহের পরিবারের উত্তরসূরিদের হাত ধরেই।
কোচবিহারের নানা জায়গার অদ্ভুত নামের সঙ্গে জড়িত রয়েছে এই রাজপরিবারের ইতিহাস। যেমন রাজাভাতখাওয়া। শোনা যায় একবার কুচবিহারের রাজা ধৈর্যেন্দ্র নারায়ণ ভূটান সেনাপতির হাতে বন্দী হয়েছিলেন। কিন্তু কোচবিহারের রাজাদের সঙ্গে ইংরেজদের সম্পর্ক ছিল মজবুত। ইংরেজদের ভয়ে ভুটান রাজা ধৈর্যেন্দ্র নারায়ণকে ছেড়ে দেন। তিনি তখন বক্সারের পথ হয়ে কোচবিহার পৌঁছান। রাজার মুক্তির আনন্দে রাজ পুরুষরা রাজার অভ্যর্থনায় বক্সায় রাজার ভাত খাওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। শোনা যায় এরপরই এই অঞ্চলের নাম হয়েছিল রাজাভাতখাওয়া।
এই রাজবাড়িতে থাকার ব্যবস্থা না থাকলেও সময় হাতে নিয়ে ইতিহাস-ভ্রমণ করা যায় একদিনের জন্য।
বর্তমানে কোচবিহার উন্নত জেলা হিসেবেই পরিচিত। কিন্তু সেই উন্নতির ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে কোচবিহার রাজবাড়ির সেই আদিবাসী জনগোষ্ঠীর নেতার। যাঁর ছোট্ট পদক্ষেপ থেকে বিস্তৃতি লাভ করে জন্ম নিয়েছে আজকের কোচবিহার।