পূর্ব বর্ধমানের জামালপুরের কাছেই চকদীঘি। পুরনো দিনের রাজবাড়ি। দরজার সমান জানালা। গম্বুজের মত ফ্রেম। সব মিলিয়ে অতীতের গন্ধে মাখামাখি। বর্ধমান সবসময়ই স্মৃতিমেদুর। স্মৃতিমধুর তো বটেই। বর্ধমান রাজবাড়ির পাশাপাশি চকদীঘির রাজপরিবারের বাগানবাড়ি ওই অঞ্চলের ঐতিহ্য রক্ষায় বিশেষভাবে উল্লেখ্য।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তখন একবার বর্ধমানে এসে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। বর্ধমান রাজ পরিবারের সঙ্গে তাঁর সখ্য ছিল গভীর। যথারীতি সাহায্যের আবেদন করলেন তিনি। কিন্তু সেই সময় রাজপরিবারের পক্ষে সাহায্য করা অসম্ভব ছিল। কারণ সেই মুহূর্তে তাঁরা ছিলেন ওই অঞ্চলের বাইরে। বিদ্যাসাগর মহাশয় তখন দিশেহারা। শরীরের অবস্থা মোটেই যুতের নেই। এদিকে ফিরে যাওয়ার উপায় নেই। কারণ শরীর সঙ্গ দিচ্ছে না কিছুতেই। চিকিৎসা এবং পথ্য দুইই প্রয়োজন। হঠাৎ করেই তাঁর মনে পড়ে চকদীঘির সিংহ রায় পরিবারের কথা। সিংহ রায় পরিবারের তরফ থেকে বিদ্যাসাগরকে নিয়ে যাওয়া হলো তাঁদের বাগানবাড়িতে। আন্তরিকতার সঙ্গে শুশ্রূষা করে বিদ্যাসাগরকে সারিয়ে তুলেছিলেন এই রাজপরিবারের মানুষরা। ফলে পরিচিতি ও আন্তরিকতা আরও গভীর হয়েছিল।
অনেক ঐতিহাসিকদের মতে চকদীঘির এই সিংহ রায় পরিবার আসলে জমিদার বাড়ি। কিন্তু তাঁদের বৈভব, সাংস্কৃতিক রুচি, ধনসম্পত্তির কারণে রাজবাড়ি হিসেবে গণ্য করা হয়।
এই রাজপরিবারে নিয়মিত আসতেন লর্ড কার্জন। তাঁর জন্য বরাদ্দ ছিল দোতলার একটি ঘর। সেটি এখনও কার্জনস রুম নামে পরিচিত। চকদীঘির সিংহ রায় পরিবার সাংস্কৃতিক দিক থেকে অত্যন্ত ঐশ্বর্যের অধিকারী ছিল। সলমন রুশদি থেকে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের মত সাহিত্য জগতের নক্ষত্ররা এই পরিবারে এসে সময় কাটিয়েছেন।
সত্যজিৎ রায়ের ঘরে-বাইরের শুটিং হয়েছিল এই বাড়িতে।
সিংহ রায় পরিবার জনকল্যাণমূলক কাজের জন্য বিখ্যাত ছিল ওই অঞ্চলে। বহুবিবাহ প্রথা বন্ধ করার ক্ষেত্রে এই পরিবারের ভূমিকা ছিল উল্লেখ্য। এমনকি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহের প্রচলনে এঁরা যথেষ্ট উদ্যোগী ছিলেন। নিজেদের পরিবারে বিধবা বিবাহ দেওয়ার চেষ্টাও করেছিলেন তাঁরা। বয়স্ক মানুষদের জন্য নানা কল্যাণকর কাজ-কর্মের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এই পরিবারের সদস্যরা। ১৮৭১ সালে চকদীঘি, জামালপুর, মেমারী রেলস্টেশন পর্যন্ত রাস্তাটি এই পরিবারের সাহায্যেই তৈরি হয়েছিল।
এই পরিবার নিয়ে নানান কথা শোনা যায়। তবে সর্বস্বীকৃত মতামতটি হল- আনুমানিক তিনশ বছর আগে উত্তর প্রদেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গে এসেছিলেন এই সিংহ রায় পরিবার। এই পরিবারের আদি পুরুষ ও সম্রাট আকবরের সেনাপতি মোঘল আমলের দশহাজারী মনসবদার রূপে এখানে বসবাস শুরু করেছিলেন। এই রাজবাড়িটি ফরাসি স্থপতিদের দ্বারা তৈরি করা হয়েছিল। এই রাজবাড়িটি মোটামুটি সংরক্ষণ করেই রেখেছে সিংহ রায় পরিবারের উত্তরসূরীরা। মোটামুটি নিয়মিত দেখাশুনা করেন তাঁরা। তবে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত নয় এই রাজবাড়ি। বিশেষ অনুমতি নিয়ে তবেই ঢোকা যায় অন্দরে।
কেউ বলেন এই রাজবাড়ীর পত্তন হয়েছিল আজ থেকে প্রায় ৩৫০ বছর আগে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজত্বকাল তখন। বুন্দেলখন্ডের রাজপুত নলসিংহ এই জমিদার বাড়ি বা রাজবাড়ির পত্তন করেন। পরবর্তীকালে তিনি সিংহ রায় উপাধি গ্রহণ করে এখানে বসবাস শুরু করেন। প্রায় ১০০ বিঘা জায়গার ওপর বাড়ি, পুকুর, বাগানসহ এই রাজবাড়ি। রয়েছে সুবিশাল গাড়ি বারান্দা।
এই বংশের এক পুরুষ সারদাপ্রসাদ ছিলেন বিদ্যাসাগরের বন্ধু স্থানীয়। বিধবা বিবাহের প্রচলনে তিনি সাহায্য করেছিলেন বিদ্যাসাগরকে। শোনা যায় বিদ্যাসাগর এই বাড়িতেই একটি গ্রন্থাগার স্থাপন করেছিলেন। যদিও সেটি সংরক্ষিত নয়। তবে কিছু বই আজও সংরক্ষণ করে রেখেছে এই পরিবার।
এই রাজপরিবারের দুর্গাপুজো বিখ্যাত। সাবেকি পুজো হয় এখানে। পুজোর সময় পরিবারের সকল মানুষ একত্রিত হন। জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত না হলেও বর্ধমানের ইতিউতি ছড়িয়ে রয়েছে এই রাজপরিবারের ইতিহাসের কথা।