সুন্দরী ডুলুং নদী। বয়ে চলে জীবনের মত। সঙ্গী অরণ্য। ঝাড়গ্রামে নদী আর অরণ্য একে অপরের পরিপূরক। আঁকড়ে ধরে রেখেছে নিজেদের। নদী, অরণ্য ঘেরা সীমারেখার ভেতরে রয়েছে ইতিহাসের এই স্থাপত্য, এই রাজবাড়ি। ঝাড়গ্রাম জেলার জামবনি পঞ্চায়েত সমিতি ১০টি গ্রাম পঞ্চায়েত নিয়ে গঠিত, এখানে অন্যতম একটি হল চিল্কিগড়। নদী আর অরণ্যে ঘেরা গ্রাম। ঝাড়গ্রামের অন্যতম দর্শনীয় স্থান চিল্কিগড় রাজবাড়ি ও কনকদুর্গা মন্দির ।
পথের ওপরেই সুবিশাল তোরণদ্বার। ঝাড়গ্রাম থেকে গিধনী যাওয়ার পথে রাস্তার ওপরে রাজবাড়ি প্রবেশের বড় তোরণদ্বার। তোরণদ্বারের গায়ে অতীতের ছাপ স্পষ্ট। বিশাল এই লোহার দরজা পেরিয়ে ভেতরে ঢুকলেই বিরাট চত্বর। রয়েছে বুড়ো অশ্বত্থ গাছ, তার পাশেই রয়েছে মন্দির। কালাচাঁদের একরত্ন মন্দির, রাধাকৃষ্ণের মন্দির ও শিবালয়। বুড়ো অশ্বত্থ গাছের ডানদিকে রয়েছে দ্বিতল রাজপ্রাসাদ। রাজপ্রাসাদ যেন সব অতীত আর স্মৃতি আগলে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ির মন্দিরের স্থাপত্যশৈলী বেশ অন্যরকম। রাজবাড়ীর বাইরে লোহার তৈরি বড় রথের কাঠামো রয়েছে। অরণ্য, নদী, নিস্তব্ধতা সব মিলিয়ে মনোরম পরিবেশ।
পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষের দিকে ময়ূরভঞ্জের রাজা প্রতাপ রুদ্র বলভদ্র ত্রিপাঠীকে জামবনি পরগনার সত্ত্ব প্রদান করেন। এই ত্রিপাঠী বংশই জামবনিতে জমিদার বাড়ির পত্তন করেন।
বর্তমানের ঝাড়গ্রাম জেলার জামবনি পরগনা ছিল অতীতের সামন্তভূম রাজ্যের অন্তর্গত। বাহাদুরপুর, কল্যাণপুর, শিলদা ও জামবনি এই চারটি পরগণা নিয়ে গঠিত ছিল সামন্তভূম রাজ্য। ১৪৭৫ সাল পর্যন্ত ময়ূরভঞ্জ রাজ্যের অন্তর্গত ছিল এই চারটি পরগনা। তারপর ১৭৯০ সাল পর্যন্ত সামন্তভূমের অন্তর্গত ছিল। নানা পরিবর্তনের হাত ধরে অবশেষে ১৯২২ সালে মেদিনীপুর জেলার ঝাড়গ্রাম মহকুমার অন্তর্গত হয় এই পরগনা।
তারপর থেকে জামবনি ঝাড়গ্রাম জেলার অংশ। বলভদ্র ত্রিপাঠী র পরিবার জামবনিতে জমিদারির শুরু করেন। এঁরা বিষ্ণু ভক্ত ছিলেন মূলত। এই ত্রিপাঠী পরিবারের উত্তর পুরুষ বিশ্বরূপ ত্রিপাঠী চিল্কিগড়ে প্রথম একটি পঞ্চড়ন্ত্র বিষ্ণু মন্দির স্থাপন করেন, পরবর্তীকালে এই মন্দিরই চিল্কিগরের বিখ্যাত কনকদুর্গা মন্দির হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছে। শোনা যায় রাজার ক্ষত্রিয় সেনাপতি ভৈরব সিংহ ত্রিপাঠী রাজাকে ডুলুং নদীর তীরে হত্যা করে রাজত্ব দখল করেন। রানীকেও হত্যা করেছিলেন সেনাপতি। আজও মহাষষ্ঠীর দিন যে পাথর চাপা দিয়ে রাজা বিশ্বরূপ ত্রিপাঠী ও রানী মহামায়াকে হত্যা করা হয়েছিল সেই পাথরকে আগে পুজো দিয়ে তারপর দেবী পুজোর সূচনা হয়। মূলত ঘটপুজোর মাধ্যমেই সূচনা হয় দেবীপুজোর। সিংহ বংশের রাজা গোপীনাথ সিংহ ১৭৪৯ সালে সিংহবাহিনী দেবী কনকদুর্গার মন্দিরটি স্থাপন করেছিলেন বিষ্ণু মন্দিরের সঙ্গে। চিল্কিগড়ের রাজবাড়িটিও গোপীনাথ সিংহের আমলেই তৈরি।
যে ভৈরব সিংহ ত্রিপাঠী রাজাদের হত্যা করেছিলেন, তার উত্তরপুরুষ ছিলেন গোপীনাথ সিংহ। কথায় আছে নিয়তির কাছে সবাই পরাজিত হয়। এই গোপীনাথ সিংহ পুত্রহীন ছিলেন। রাজার একমাত্র কন্যা ছিলেন সুবর্ণমণি। শোনা যায় রাজা এই সুবর্ণমণিকেই রাজউত্তরাধিকারী হিসেবে ঘোষণা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আত্মীয়-পরিজনদের কথায় পিছিয়ে যান। পরে সুবর্ণমণির স্বামী ধলভূমগড়ের রাজা জগন্নাথ সিংহ দেও ধবলদেবকে পরবর্তী রাজা হিসেবে চিহ্নিত করেন গোপীনাথ সিংহ। চিল্কিগড় রাজবাড়ির রাজা হন জগন্নাথ সিংহ। যদিও তার পুত্র কমলাকান্ত দেও ধবল দেবের সময়কে চিলকিগড়ের স্বর্ণযুগ বলে মনে করা হয়। এই চিল্কিগড় রাজবাড়ি থেকেই ধল-বিদ্রোহ পরিচালনা হয়েছিল। সিংহ পরিবারের সঙ্গে রাজা-রানীকে হত্যা করার ইতিহাস জড়িয়ে থাকলেও, পরবর্তীকালে এই রাজবাড়ির সিংহরাজারা নিজেদের প্রজাবৎসল হিসেবে প্রমাণ করেছিলেন।
চিল্কিগড়ের কনকদুর্গা মন্দির তার স্থাপত্যশৈলীর জন্য বিখ্যাত। মন্দিরে রয়েছে গর্ভগৃহ ও খোলাবারান্দা। দুর্গার বিগ্রহটি অষ্টধাতু নির্মিত। অশ্বারোহিনী চতুর্ভুজা দুর্গা। কথিত আছে চিল্কিগড়ে সামন্ত রাজা গোপীনাথ সিংহ স্বপ্নাদেশ পেয়ে স্ত্রীর হাতের কাঁকন দিয়ে তৈরি করান দেবীর অষ্টধাতুর মূর্তি। আগে যদিও অমাবস্য্যায় এখানে নরবলি হত। পরবর্তীকালে নরবলি বন্ধ হয়। শোনা যায় সেটাও নাকি দেবীর আদেশেই বন্ধ হয়। পরবর্তীকালে রাজা কমলাকান্ত বিষ্ণুকে ডুলুং-এর ওপারে অবস্থিত রাজবাড়ির অন্তঃপুরে স্থানান্তরিত করলেও দৈবনির্দেশে দেবী কনকদুর্গাকে স্থানান্তরিত করতে পারেননি। তবে মন্দির থেকে বিগ্রহ চুরি হয়েছিল। রাজতন্ত্র বিলোপের পর এই চুরি হয়। দীর্ঘদিন ধরে মূর্তি ছাড়াই পুজো হতো। রাজার বংশধরেরা পরবর্তীকালে দেবী দুর্গার আরেকটি অষ্টধাতুর বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন।
মন্দির সংলগ্ন অঞ্চলে ওষধি গাছের চাষ হয়। সমগ্র ভারতের উদ্ভিদবিজ্ঞানীরা গবেষণার কাজে এই বনভূমিতে আসেন। রাজার উত্তরসূরীরাই আয়ুর্বেদ চর্চার এই ক্ষেত্র তৈরি করেছিলেন। রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় এই রাজবাড়ি এবং তার সংলগ্ন মন্দির অঞ্চলের। তবে রাজবাড়ির একটি অংশ একেবারেই মলিন ও ম্লান হয়ে পড়ে রয়েছে । জীবনের মতই একদিকে ভরে ওঠা এবং অন্যদিকে হারানোর যন্ত্রণা নিয়ে টিকে রয়েছে চিল্কিগড় রাজবাড়ি।