ইতিহাস বড় বিস্ময়কর। সে আপন গতিতে বয়ে চলে, এগিয়ে যায়। তবু ফেলে রেখে যায় স্মৃতি। কথিত আছে জৈনদের চব্বিশতম তীর্থঙ্কর মহাবীর বা বর্ধমান স্বামী বর্ধমানের অষ্টিকাগ্রামে নাকি বেশ কিছুদিন বসবাস করেছিলেন। তাঁর নামেই এই জনপদের নাম হয় বর্ধমান। মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালেও এই শহরের নাম পাওয়া যায় ইতিহাসের পাতায়।
তখন নামছিল বধ-ই-দিওয়ান। সেখান থেকে বর্ধমান হওয়ার ইতিহাস বেশ লম্বা-চওড়া। বর্ধমান জেলার ইট-কাঠ-পাথরের খোদাই করা সেইসব স্থাপত্যের ইতিহাস। বদলে বদলে যাওয়া এই জনপদের খোলসের আড়ালে আজও বাস করে অজানা সব ইতিহাসের কাহিনী। খানিকটা কাল্পনিক, খানিকটা সত্য। সব মিলিয়ে এই জেলার ইতিহাস অনেক অজানা ভার আজও বয়ে চলেছে।
আগে এই বর্ধমান রাজবাড়ি ছিল শহরের কাঞ্চননগর এলাকায়। সেখানেই থাকতেন রাজ পরিবারের সদস্যরা। দিব্যি শাসন কাজ চালাচ্ছিলেন সেখান থেকে। কাঞ্চননগর এলাকা ছিল দামোদর নদের একেবারে কাছে। বন্যাপ্রবণ দামোদর বারবার শাসন কাজে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছিল। শোনা যায় বন্যার ফলে সেই সময় রাজবাড়ির অনেক গুরুত্বপূর্ণ নথি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। তখন বর্ধমানের রাজা ছিলেন মহারাজ তেজচাঁদ। তিনি বাধ্য হয়ে শহরের উঁচু জায়গায় রাজবাড়ি তৈরীর পরিকল্পনা শুরু করলেন।
তেজচাঁদের নিজের কোনও সন্তান ছিল না। তেজচাঁদের দত্তক পুত্র ছিলেন মহাতাবচাঁদ। তেজচাঁদ তাঁর পরিকল্পনা রূপায়িত করা ভার দিয়ে যান দত্তকপুত্রকে। মহাতাবচাঁদ সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করলেন। ১৮৫১ সালে বর্ধমানের অপেক্ষাকৃত কম বন্যাপ্রবণ এলাকায় রাজবাড়ি তৈরীর কাজ সম্পূর্ণ হয়। মহারাজ মহাতাবচাঁদ তৈরি করেছিলেন বলেই রাজবাড়ির নাম ছিল মহাতাব-মঞ্জিল।
এটি ছিল বর্ধমানের রাজার খাস হাভেলি। শাসনকার্যের নানা পরিকল্পনা, বিচার ব্যবস্থা শুরু হয় এই রাজবাড়ি থেকে। ১৮৮০ সালে কাঞ্চননগর এলাকার রাজবাড়ি থেকে সকলেই এই অঞ্চলে চলে আসেন। বর্ধমানের এই রাজবাড়ি থেকে মহাতাবচাঁদ, আফতাবচাঁদ, বিজয়চাঁদ ও উদয়চাঁদ এই চার রাজা রাজত্ব পরিচালনা করেছেন। ১৯৫২ সালে তৎকালীন ভারত সরকারের জমিদারি বিলুপ্তি আইনে অবসান হয় রাজতন্ত্রের। এই রাজত্ব সরকারের হাতে চলে যায় অবশেষে। তখন বর্ধমান-এর রাজা ছিলেন মহারাজ উদয়চাঁদ।
তিনি কলকাতার কালীঘাটের বাড়ি বড় ছেলেকে এবং দার্জিলিংয়ের রাজবাড়ি ছোট ছেলেকে দিয়ে দেন। পশ্চিমবঙ্গের সেইসময় মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন বিধানচন্দ্র রায়। তিনি মহারাজের কাছে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় তৈরীর জন্য রাজবাড়ির কিছু অংশ ব্যবহার করার আবেদন জানান। ১৯৫৮ সালে বর্ধমান রাজ পরিবার রাজ্য সরকারের হাতে রাজবাড়ি তুলে দেয়। সেই রাজবাড়িতেই বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের পথ চলা শুরু হয় ওই বছরেই। প্রথম উপাচার্য ছিলেন সুকুমার সেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবন রাজবাড়ির এই অংশে আজও রয়েছে। তবে পড়াশোনা হয় রাজবাড়ির গোলাপবাগ ক্যাম্পাসে। উপাচার্যের অফিস তবে রয়েছে পুরনো রাজবাড়ির অংশে।
২০০৯ সালে রাজ্য হেরিটেজ কমিশন বর্ধমান রাজবাড়িকে হেরিটেজ বিল্ডিং ঘোষণা করে। সিদ্ধান্ত হয়েছিল বিশেষ সংস্কারের। রাজবাড়ি সংস্কারের পর তা দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। মিউজিয়াম, 'লাইট অ্যান্ড সাউন্ড'-এর মাধ্যমে রাজবাড়ির ইতিহাস মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।
তবে উদয়চাঁদ, মহাতাবচাঁদ এঁদের আগেও আরেক রাজার কথা জনশ্রুতি হিসেবে প্রচলিত আছে বর্ধমানের সঙ্গে। বর্ধমান শহরের অন্যতম প্রাচীন মন্দির সর্বমঙ্গলা মন্দির। রাজা না হয়েও রাজা বলে বিখ্যাত কীর্তিচন্দের আমলে এই মন্দির তৈরি হয়েছিল। শোনা যায় এই মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত অষ্টাদশভূজা দেবীমূর্তির পায়ের কাছে কিছু একটা লেখা রয়েছে। কথিত আছে বর্ধমানের এক পুকুরের পাঁকে নাকি নিমজ্জিত ছিলেন দেবী।
একদিন দেবী বর্ধমানের সেই সময়ের রাজাকে স্বপ্নে বললেন ''তোর রাজত্বে এই ভাবে পড়ে থাকতে হবে আমায়, আমায় উদ্ধার করে মন্দির প্রতিষ্ঠা কর।'' বেশ কয়েকজন ব্রাহ্মণদের সহযোগিতায় রাজা উদ্ধার করেছিলেন দেবী মূর্তি। এই কীর্তি চন্দের আমল থেকেই বর্ধমানের কাঞ্চননগরে স্থাপিত হয়েছিল বারোদুয়ারী। রাজার যুদ্ধ জয়ের স্মৃতিসৌধ হিসেবে। পরে এতেই রাজবাড়ি হিসেবে বসবাস করতেন রাজার বংশধরেরা। তবে বর্ধমান জেলার অনেক ইতিহাসই জনশ্রুতি নির্ভর। বইতে মেলে না তাদের খোঁজ। এভাবেই ইট-কাঠ-পাথরের একটা জেলা আজও বয়ে চলেছে অনেক অব্যক্ত ইতিহাসের ভার।