প্রজাদের অন্নকষ্ট দূর করার জন্য রাজবাড়ির ভেতরেই শস্য উৎপাদনের ব্যবস্থা করেছিল এই রাজ পরিবার

দীর্ঘ সময় ধরে জিয়ো বাংলার পাতায় রাজবাড়ির কথা গ্রীষ্মের দিনের বৃষ্টির পর ঠান্ডা বাতাসের মতো উড়ে বেড়িয়েছে। অতীত, স্মৃতি, স্থাপত্য, ভাস্কর্য সবকিছুই থেকেছে, তবে কখনও সবকিছুকে ছাপিয়ে প্রাধান্য পেয়েছে মানুষের গল্প। প্রজাবৎসল রাজারা ঈশ্বরতুল্য। আবার অত্যাচারী রাজারা আজীবন অভিশাপ কুড়িয়েছেন। এইসব স্মৃতি রাজবাড়ির কোটরে কোটরে আজও হয়তো লেগে রয়েছে। তবে শুধু রাজা কেন, বৈচিত্র্যময়তার দিক থেকে রানীরাও যথেষ্ট অনন্য। কোন রানী তার নিজের গয়না বিক্রি করে সাহায্য করেছেন প্রজাদের। কোন রানী সন্তানপালনের সঙ্গে সঙ্গে একাই লড়েছেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে।
 
কিছু রাজবাড়ি ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের কেন্দ্রস্থল। কিছু রাজবাড়ী আবার জন্ম দিয়েছে বিপ্লবের। সব মিলিয়ে যুগ যুগ ধরে রাজবাড়ি ইতিহাসকে ধরে রেখেছে। যে ইতিহাস শুধুমাত্র বইয়ের পাতায় থেমে থাকেনি। যে ইতিহাস মানুষের কথা বলেছে, যে ইতিহাস আজও সময়ের কথা বলে চলে। জিয়ো বাংলার পাতায় নির্দিষ্ট  পথ পেরিয়ে রাজবাড়িরা এভাবেই সাবালক হয়েছে। আজ রাজবাড়ির শেষ পর্ব। তথ্য, লেখা, তত্ত্ব শেষ হলেও এই ইতিহাস অতীতের পাতায় ঝিলমিল করে বেঁচে থাকবে। আজ শেষ পর্বে বাঁশবেড়িয়া রাজবাড়ির কথা জানব।
 
বাঁশবেড়িয়া হুগলি জেলায় অবস্থিত। বাঁশবেড়িয়া মূলত বিখ্যাত হংসেশ্বরী মন্দিরের কারণে। বাঁশবেড়িয়ার আগের নাম ছিল বংশবতী। ভাগীরথী নদীর তীরে অবস্থিত বাঁশবেড়িয়া ছিল বাঁশবনঘেরা অঞ্চল। সে সময় বংশবতী ছিল সপ্তগ্রামের অধীনে। সরস্বতী নদীর ধারে গড়ে উঠেছিল এই জনপদ।
 
কালের স্রোতে বিলীন হয়েছে সরস্বতী নদী। তবুও এই মরা নদী সঞ্চয় করেছে ইতিহাস। কথিত আছে সরস্বতী নদীর তীরে নাকি বন্দর এলাকা ছিল। এই নদীর তীরেই গড়ে তোলা হয়েছিল হংসেশ্বরী মন্দির। রাজা নৃসিংহদেব তৈরী করিয়েছিলেন হংসেশ্বরী মন্দির। এই মন্দিরের পাশে রয়েছে প্রাচীন রাজবাড়ি।
 
ঐতিহাসিকরা বলেন দত্ত বংশের তৈরি এই রাজবাড়ি। মূল প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন দ্বারিকানাথ দত্ত। মুঘল আমলে মুসলমানদের অত্যাচার থেকে বাঁচতে দ্বারিকানাথ পাটুলিতে পালিয়ে যান। পরবর্তীকালে তার বংশধর জয়ানন্দ দত্ত ফিরে এসে হুগলির বাঁশবেড়িয়ায় থাকতে শুরু করেন। জয়ানন্দের জ্যেষ্ঠ পুত্র রাঘবেন্দ্র দত্ত। শোনা যায় এই দ্বিতীয় পর্বে বাঁশবেড়িয়ায় থাকতে এসে তৈরি করা হয় এই রাজবাড়ি।
 
রাজবাড়িটি ৪০১ বিঘা জমির উপর তৈরি।  ঐতিহাসিকরা বলেন সপ্তদশ শতাব্দীতে নবাব ঔরঙ্গজেবের কাছ থেকে দত্তরা পুরস্কার হিসেবে পেয়েছিলেন এই জমি। সঙ্গে পাঁচ টুকরো কাপড় আর বারোটি পরগণা। পাঁচ টুকরো কাপড়কে ইংরেজিতে বলা হত পাঞ্জ-পারচে। রাজ পরিবারের বড় ছেলেকে দেওয়া হত এটি।
 
এই রাজ-পরিবারের শ্রেষ্ঠ রাজা রামেশ্বর দত্ত। সাহসী, বুদ্ধিমান, প্রজাবৎসল রাজা ছিলেন তিনি। জমি থেকে উচ্চকর আদায়ের প্রতিরোধ করেছিলেন তিনি। নবাব তাঁকে সর্বশ্রেষ্ঠ রাজা হিসেবে সম্মানিত করেছিলেন।
 
তিনি রাজবাড়ির ভিতরে দুর্গ তৈরি করেছিলেন। রাজবাড়ির সুরক্ষার জন্য কামান স্থাপিত করেন সেখানে। একদিকে যেমন তিনি রাজবাড়ি ও সংলগ্ন অঞ্চলের সুরক্ষার কথাও চিন্তা করতেন, অন্যদিকে দুর্গের ভেতরে শস্য উৎপাদনের ব্যবস্থা করেছিলেন। ‌ তাঁর উদ্দেশ্য ছিল কোন প্রজা যাতে কোনদিন খাদ্য সংকটে না পড়ে। বাঁশবেরিয়ায় রাজা রামেশ্বর দত্ত অনন্ত বাসুদেবের মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এটি বাংলার অন্যতম সেরা টেরাকোটা স্থাপত্য-শিল্প। এই রাজবাড়িতেও আক্রমণ করেছিল বর্গিরা। তবে রাজার বুদ্ধিমত্তায় বিশেষ ক্ষতি হয়নি রাজ পরিবারের। কেউ বলেন, এই রাজ পরিবারের তরফেই হংসেশ্বরী মন্দির স্থাপন করা হয়েছিল। কেউ আবার বলেন হংসেশ্বরী মন্দিরের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল রাজ পরিবারের অনেক আগেই। বাঁশবেড়িয়া রাজবাড়ি ও হংসেশ্বরী মন্দির হুগলির অন্যতম স্থাপত্য। এভাবেই ইতিহাস, স্মৃতি ও অতীত রাজবাড়ি ও মন্দিরকে ঘিরে রেখেছে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...