তখন অবিভক্ত বাংলা। মুঘল সম্রাট ছিলেন ঔরঙ্গজেব। নওগাঁর বলিহার এলাকার এক জমিদার জায়গির লাভ করেছিলেন মুঘল সম্রাটের থেকে। সম্রাটের সঙ্গে জমিদারের সম্পর্ক ছিল আন্তরিক। বলিহার অঞ্চলকে সাজানোর দায়িত্ব দিলেন সম্রাট। জমিদারের উদ্যোগে বলিহারে স্থাপিত হল বেশ কয়েকটি স্থাপত্য। বলিহার রাজবাড়ি ও একটি স্থাপত্য হিসেবেই গড়ে তুলেছিলেন সেখানকার জমিদার। আসলে তখনও জমিদার হিসেবেই পরিচিত ছিলেন বলিহারের এই জমিদার বংশের উত্তরসূরিরা। কিন্তু পরে বলিহার জমিদার পরিবারের কৃষ্ণেন্দ্রনাথ রায় বাহাদুর রাজা খেতাব পেয়েছিলেন ব্রিটিশদের থেকে। তাই পরে জমিদারদের তৈরী এই ভবন বলিহার রাজবাড়ি হিসেবে পরিচিত হয়।
সময়টা ১৮২৩ সাল। বলিহারের জমিদার রাজেন্দ্রনাথ এই অঞ্চলে তৈরি করালেন একটি মন্দির। রাজ-রাজেশ্বরী দেবীর মন্দির নির্মাণ করিয়েছিলেন তিনি। এই মন্দিরে পিতলের তৈরি রাজ-রাজেশ্বরী দেবীর একটি মূর্তি স্থাপন করেছিলেন। পরবর্তীকালে এই মন্দিরকে ঘিরে গড়ে ওঠে পর্যটন স্থান। বলিহারদের জমিদাররা গুণী মানুষ ছিলেন প্রত্যেকেই। প্রত্যেকেই ছিলেন উচ্চশিক্ষিত।
এই জমিদার পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন নৃসিংহ চক্রবর্তী। তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বলিহার রাজবাড়ি। এই পরিবারের রাজা কৃষ্ণেন্দ্রনাথ রায় বাহাদুর বিখ্যাত লেখক ছিলেন। তাঁর লেখা উল্লেখযোগ্য গ্রন্থাবলী- কৃষ্ণেন্দু গ্রন্থাবলী প্রথম ও দ্বিতীয় খন্ড।
এই রাজবাড়ি র সামনে রয়েছে বিশাল তোরণ। দরজা ধরে এগোলেই সামনে পড়বে নাটমন্দির। রাজরাজেশ্বরী মন্দির ও জোড়া শিবমন্দির। এছাড়াও আরো একটু এগোলে এই রাজবাড়ির সঙ্গে রয়েছে আরেকটি ভবন। তিনতলা। এটিকেও জমিদারবাড়ি হিসেবেই বলা হয়। জমিদারদের আমলে নির্মিত হয়েছিল। এই রাজবাড়ির সঙ্গে যুক্ত রয়েছে প্রায় তিনশোর বেশি দীঘি এবং পুকুর। প্রত্যেকটি পুকুরের এবং দীঘির রয়েছে আলাদা নাম। যেমন- মালাহার, সীতাহার, বলিহার, অন্তাহার ইত্যাদি।
এই পুকুর ও দীঘি খনন নিয়ে রয়েছে একটি জনশ্রুতি। তখন মুঘল সম্রাট ছিলেন আকবর। বলিহার রাজবাড়ি তখনও তৈরি হয়নি। মূলত জমিদার হিসেবেই পরিচিত ছিলেন বলিহার পরিবারের মানুষেরা। এই সময়ে মুঘল সম্রাট আকবরকে রীতিমত অতিষ্ঠ করে তুলেছিল বারোজন জমিদার অর্থাৎ ভূস্বামী।
এই বারো ভুঁইয়াদের নিয়ে কথিত আছে নানা জনশ্রুতি। কোন ঐতিহাসিক বলেন প্রাচীনকালে হয়তো বাংলায় বারোজন শক্তিশালী সামন্ত রাজা ছিলেন যাঁরা আকবরের কাছে বশ্যতা স্বীকার করতে নারাজ ছিলেন। তাদেরকেই বারো ভুঁইয়া বলা হত। অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন দেশের মসনদে যেই থাকুক না কেন, বাংলায় রাজত্ব করত মূলত বারো জন জমিদার বা শাসক। এদেরই বারো ভুঁইয়া বলে। এমনকি বাংলায় পাঠান বংশ দুর্বল হয়ে পড়লে বাংলাদেশের সোনারগাঁও, খুলনা-বরিশাল প্রভৃতি অঞ্চলে এই জমিদাররা স্বাধীনভাবে রাজত্ব করতেন। ইতিহাসের পাতায় এমন বারো জন জমিদার বা সামন্ত রাজার নামও পাওয়া যায়। সম্রাট আকবরকে নাস্তানাবুদ করেছিলেন এই বারো ভুঁইয়ারা।
মুঘল সম্রাট আকবরের সেনাপতি রাজা মানসিংহ বাংলার বারো ভুঁইয়াদের দমন করতে সৈন্য-সামন্ত নিয়ে বলিহার পৌঁছেছেন তখন। সৈন্যবাহিনী দীর্ঘ পথ অতিক্রম করায় ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। তাদের বিশ্রামের জন্য এবং সেনাপতি মানসিংহের পাঠানো গুপ্তচরের মাধ্যমে বারোভুঁইয়াদের খবর জানতে মানসিংহ এই রাজবাড়ি এলাকায় তাঁদের যাত্রাপথের বিরতি ঘোষণা করে। যদিও তখনও এটি জমিদার বাড়িই ছিল মূলত। এই সময়ে বরেন্দ্র অঞ্চলে খরা চলছিল। এদিকে গুপ্তচরেরা কিছুতেই খবর নিয়ে সময়মতো ফিরে আসে না। সৈন্যরাও একভাবে বসে থেকে বিরক্ত হচ্ছেন। অলস হয়ে পড়ছিলেন তাঁরা। মানসিংহ নাকি তখন তাদের দিয়ে তিনশটিরও বেশী পুকুর ও দিঘী খনন করেছিলেন। পরে এই পুকুরগুলোর নামকরণ করেছিলেন বলিহারের জমিদার ও রাজারা।
বলিহারের রাজারা পশুপাখি খুব ভালোবাসতেন। তাই প্রাসাদের মধ্যেই তৈরী করিয়েছিলেন চিড়িয়াখানা।
দেশভাগের সময় বলিহারের রাজা ছিলেন বিমলেন্দু রায়। জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হওয়ায় বলিহারের রাজা চলে যান ভারতে। রাজবাড়ি যদিও দেখাশোনা করতেন রাজ পরিবারের অন্য সদস্যরা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এই রাজবাড়ির অনেক সম্পদ লুট হয়ে গিয়েছিল।
এর পরে রাজবাড়ি র একটি ভবন স্থানীয় এক স্কুলের শ্রেণীকক্ষ হিসেবে ব্যবহৃত হত কিছুদিন। কিন্তু সেই স্কুলের নতুন ভবন তৈরি হওয়ার পর পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে বলিহার রাজবাড়ি। যদিও মন্দিরে পুজো-অর্চনা এখনো হয় নিয়মিত।
রাজবাড়ি বা জমিদারবাড়ির সঙ্গে বরাবর জড়িয়ে থাকে এমন ইতিহাস। সবটার তথ্য-প্রমাণ পাওয়া সম্ভব হয় না। খানিকটা কল্পনাশ্রয়ী আর খানিকটা জনশ্রুতি মিলিয়েই গড়ে ওঠে এমন অজানা-অচেনা ইতিহাসের গল্প। পরিত্যক্ত, ভাঙা, আগাছাময় এমন সব স্থাপত্যের অন্দরে লুকিয়ে থাকে কত অজানা গল্প। ঠিক পরশ পাথরের মতন।