রাজবাড়ি পর্ব ১২ঃ বলাখানা রাজবাড়ি

সময়টা সপ্তদশ শতকের শেষ দিকে। কৃষ্ণনগরের জলঙ্গী নদীর তীর। তখন বাংলায় নীলচাষের রমরমা। এই জলঙ্গী নদীর তীরে বলাখানা অঞ্চলে নীল চাষ হত। এক ফরাসি নীলকর সাহেব এই অঞ্চলে নীল চাষের দেখাশোনা করতেন। নীলচাষের রীতিমতো সুদিন চলছিল সে সময় বলাখানায়। খুশি ছিলেন সেই ফরাসি সাহেব। ঠিক করলেন গড়ে তুলবেন নীলকুঠি। জলঙ্গী নদীর তীরে বিশাল অঞ্চল নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন নীলকুঠি। সেই নীলকুঠিতে তিনি দীর্ঘদিন বসবাস করেছিলেন।

তারপর সময়ে এগিয়েছে। নীলবিদ্রোহ বন্ধ করিয়েছে নীল চাষ। সেই ফরাসি সাহেব তখন বলাখানা নীলকুঠি বিক্রি করে দিতে চাইলেন। ভারতে তখন ইংরেজদের ঘাঁটি প্রতিষ্ঠিত। সেই বিশাল নীলকুঠি কিনে নেন জনৈক ইংরেজ সাহেব। শোনা যায় তারপরেও অনেক বার হাতবদল হয়েছে এই নীলকুঠির।

 

Balakhana1

১৮৭০ সাল নাগাদ সেই নীলকুঠি বিক্রি করতে চাওয়ার বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন সেই সময়ের মালিক হেনরি নেসবিট। হেনরির জন্ম হয়েছিল এই বলাখানাতেই।

বাংলার বিখ্যাত ব্যবসায়ী ও জমিদার পাল চৌধুরী পরিবারের বিপ্রদাস পাল চৌধুরী তখন  ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছেন বিলেতে। তাঁর চোখে পড়েছিল এই বিজ্ঞাপন। বিপ্রদাস পালচৌধুরি সেই বিজ্ঞাপনের কথা জানান তাঁর দাদা নফর চন্দ্র পাল চৌধুরীকে। দাদা ছিলেন ভাই অন্ত-প্রাণ। ঈশ্বরের কৃপায় অর্থের কোন অভাব ছিল না এই জমিদার পরিবারের। ভাইয়ের ইচ্ছায় অবশেষে দাদা নফর চন্দ্র পাল চৌধুরী ১৮৭৫ সালে বলাখানার নীলকুঠি কিনে নেন। বিপ্রদাস পালচৌধুরির জন্যই মূলত কেনা হয়েছিল বাড়িটি। আজও পাল চৌধুরী পরিবার এই বলাখানা রাজবাড়ি র মালিক। যদিও জনশ্রুতি রয়েছে পাল চৌধুরী পরিবারের কোন এক উত্তরসূরী পরে রাজা উপাধি লাভ করেছিলেন ব্রিটিশদের থেকে। তাই একে বলাখানা রাজবাড়ি বলে। তবে এই বলাখানার সঙ্গে মূলত যুক্ত হয়ে রয়েছে বিপ্রদাস পাল চৌধুরীর নাম।

 

Balakhana2

ফরাসি সাহেবের নীলকুঠিকে আমূল বদলে দিয়েছিলেন বিপ্রদাস পাল চৌধুরী। তিনি এই পরিবারের ব্যবসাকে উন্নতির শিখরে পৌঁছে দিয়েছিলেন। উত্তরবঙ্গের দার্জিলিং ও আসামের চা শিল্প প্রসারে তাঁর অবদান অসীম। বিপ্রদাস পাল চৌধুরীর আমলে সমগ্র বাংলা ব্যবসা বাণিজ্য উন্নতির মুখ দেখেছিল।

বিপ্রদাস পাল চৌধুরী-এর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র রণজিৎ বাড়ির মালিক হন। এই পাল চৌধুরি পরিবারের প্রত্যেকেই ছিলেন উচ্চশিক্ষিত। রনজিত পাল চৌধুরী একজন দক্ষ পাইলট ছিলেন। বলাখানা রাজবাড়িতে একটি ছোট এয়ারস্ট্রিপ তৈরি করেছিলেন তিনি। শোনা যায় তার এই এয়ারস্ট্রিপ দেখতে ভিড় হত কলকাতা থেকে। কথিত আছে স্বয়ং সুভাষচন্দ্র বসু এই এয়ারস্ট্রিপ দেখতে এসেছিলেন।

 

Balakhana3

মোট সতেরো একর জায়গার ওপর তৈরি এই রাজবাড়ি। বারো হাজার বর্গফুটের রাজবাড়ি ইতালিয়ান স্থাপত্যে সাজানো। বর্তমানে শ্রী রনধীর পাল চৌধুরী এই সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণ করেন। বলাখানা রাজবাড়ি মহেশগঞ্জ এস্টেট হিসেবেও পরিচিত। নদীয়ার কৃষ্ণনগর থেকে প্রায় বারো কিলোমিটার দূরে নবদ্বীপ ঘাট রোডের উপর অবস্থিত এই রাজবাড়ি। এই রাজবাড়ির বিশেষ আকর্ষণ চার ফুট উঁচু ছত্রিওয়ালা খাট যাতে উঠতে তিন ধাপ সিঁড়ি পেরোতে হয়। পুরনো দিনের সব আসবাবপত্র দিয়ে সাজানো এই রাজবাড়ি রক্ষণাবেক্ষণের দিক থেকে অনেকখানি এগিয়ে।

 

Balakhana4

এই রাজবাড়িতে সারা সপ্তাহ জুড়েই থাকা, খাওয়ার ব্যবস্থা করা আছে। এমনকি কৃষ্ণনগরের আশেপাশে অনেক দর্শনীয় স্থান ঘুরে নেওয়া যায় এই রাজবাড়ি থেকে। যোগাযোগ ব্যবস্থার দিক দিয়েও এই রাজবাড়ি অত্যন্ত সুগম। ট্রেনে করে কৃষ্ণনগর স্টেশন পৌঁছে গেলেই, যে কোন ভাবে খুব সহজেই পৌঁছানো যায় এই রাজবাড়ি।

সুন্দর থাকার ব্যবস্থা, এলাহি খাওয়া-দাওয়া সব কিছুর মধ্যেও এই রাজবাড়ি তে আজও মিঠে সুরের মতো গুনগুন করে অতীত।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...