রাজবাড়ি পর্ব ১৪ঃ আমাদপুর রাজবাড়ি

হাওড়া-বর্ধমান মেনলাইন থেকে আট কিলোমিটার উত্তরে বর্ধমানের মেমারির একটা গ্রাম আমাদপুর। ঠিক যেন টেরাকোটার দেশ। শিল্পীদের শিল্পকলার গ্রাম। দেখেই মন জুড়িয়ে যায়। দূষণহীন, সবুজ। পোড়ামাটির মন্দিরে চোখ ধাঁধানো টেরাকোটার কাজ। আপাত সাধারণ গ্রাম মনে হলেও এই অঞ্চলের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে জমিদারবাড়ি ও রাজবাড়ির ইতিহাস।

ইতিহাসের শুরু প্রায় ৪০০ বছরের আগে। আমাদপুর তখন একেবারে প্রত্যন্ত গ্রাম ছিল। ফাঁকা মাঠ, সবুজ গাছপালার মাঝে কাঠের স্তূপ আর শ্মশান, এই ছিল আমাদপুরের পুরনো ছবি। মূলত আদিবাসীদের গ্রাম ছিল এটি। সাঁওতাল আদিবাসীদের গ্রাম। তাদের মূল জীবিকা সে সময় ছিল কাঠ কাটা।

 

AmadpurRajbari1

এদিকে বাংলায় তখন বর্গীদের আক্রমণ শুরু হয়েছে। সাধারণ মানুষরা নানান জায়গায় দিশাহীন ভাবে পালিয়ে বাঁচছে। তেহট্টের বাসিন্দা দূর্গা রাম সেন শর্মা এই আমোদপুর এসে উঠলেন। উত্তরাধিকার সূত্রে অর্থবান‌ ছিলেন তিনি। কথিত আছে আমাদপুর গ্রামের জাগ্রত দেবতার মন্দির ছিল শ্মশান কালীর মন্দির, এই মন্দির আবার বামাকালী মন্দির নামেও পরিচিত ছিল। এই মন্দিরেই নাকি প্রথমবার এসেছিলেন দূর্গা রাম সেন শর্মা। দূর্গা রাম সেন শর্মা প্রথমবার এই গ্রামকে উন্নত করার কথা চিন্তাভাবনা করলেন। মুঘল সম্রাট তাঁকে চৌধুরী উপাধি দিয়েছিলেন।

তিনি নিজের চৌধুরী উপাধি নিয়ে তাঁর কূলদেবতা রাধা মাধবের পুজো করে জমিদারি শুরু করেছিলেন আমাদপুরে। কিন্তু যে জমিদারবাড়িটি তিনি গড়ে তুলেছিলেন, সময়ের স্রোতে তা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে গিয়েছিল। দূর্গা রাম সেন শর্মার পরবর্তী কয়েক প্রজন্ম সেভাবে এই জমিদারি রক্ষা করতে পারেননি। অনেক পরে হাল ধরেছিলেন এই পরিবারের উত্তরসূরি শিলাদিত্য চৌধুরী। শিলাদিত্য চৌধুরী সংস্কার করে অবিকল পুরনো বাড়ির আদলে আর একটি বাড়ি তৈরি করেন।

 

AmadpurRajbari2

 

শিলাদিত্য চৌধুরীর তৈরি বাড়ি, দুর্গাদালান, দোল মঞ্চের আদলে শিলাদিত্য চৌধুরী গড়ে তোলেন আরেকটি বাড়ি। শিলাদিত্য চৌধুরীর তৈরি করা বাড়িটি আমাদপুর রাজবাড়ি নামে পরিচিত। কথিত আছে শিলাদিত্য চৌধুরীকে পরবর্তীকালে রাজা উপাধি দেওয়া হয়েছিল। যদিও কেউ কেউ মনে করেন শিলাদিত্য চৌধুরীর আমলে আমাদপুরের বৈভব, প্রাচুর্যের কারণেই তাঁর তৈরি করা বাড়িকে রাজবাড়ি বলে।

তবে শিলাদিত্য চৌধুরী ছাড়াও এই পরিবারের তৈরি আরও কয়েকটি জমিদার বাড়ি রয়েছে, সবই ধ্বংসের পথে। একমাত্র এই রাজবাড়িটি সুরক্ষিত ও সংরক্ষিত। এই রাজবাড়ির মোট চারটি ঘরে পর্যটকদের থাকার ব্যবস্থা করা রয়েছে। হেরিটেজ হোমস্টে হিসেবে এর নাম 'বৈঠকখানা আমাদপুর'

 

AmadpurRajbari3

এই বাড়ির দোতলায় অন্দরমহলে সাজানো রয়েছে মূর্তি ও বেশকিছু দুষ্প্রাপ্য ছবি। এই রাজবাড়ির আসবাবপত্রের কারুকার্য অসাধারণ। ঝাড়বাতি, বেলজিয়াম কাচের আয়না, সূক্ষ্ম কারুকার্যের পালঙ্ক, পালিশ করা শ্বেতপাথরের টেবিল, সব মিলিয়ে অতীতের কথা বলে।

আমাদপুরের অন্যতম আকর্ষণ এই চৌধুরীদের তৈরি মন্দির। প্রতিটি মন্দিরেই রয়েছে টেরাকোটার কাজ। আমাদপুর জমিদার বাড়ির কাছে রয়েছে চারটি আটচালার মন্দির। তবে চতুর্থটি অষ্টভুজাকৃতি। এই মন্দিরের সঙ্গেই যুক্ত রয়েছে দোলমঞ্চ। প্রতিবছর দোলে এখনো উৎসব হয়। এছাড়াও রাজবাড়ির সঙ্গে যুক্ত রয়েছে  নাটমন্দির। আমাদপুরের রাধামাধবের মন্দিরটি তৈরি করেছিলেন শিলাদিত্য চৌধুরী। এই মন্দিরটি অপেক্ষাকৃত নতুন। এই মন্দিরকে ঘিরে নানা উৎসব হয় সারা বছর। বাকি মন্দিরগুলি ষোড়শ শতকে তৈরি। এই মন্দিরটি তৈরি হয়েছিল আনুমানিক ১৭৩৯ সালে। তবে এই মন্দিরটি সম্প্রতি সংস্কার করা হয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে একটি বড় মন্ডপ, তাই এর টেরাকোটার কাজ সুস্পষ্ট নয়।

 

AmadpurRajbari4

আমাদপুর-এর অন্যতম দর্শনীয় স্থান নর্মদেশ্বর আশ্রম। এই আশ্রমের সঙ্গেও যোগ ছিল জমিদারবাড়ির। একটি পুকুর ও বটগাছকে কেন্দ্র করেই আশ্রমটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

আমাদপুর রাজবাড়ির একটি রহস্যময় অংশ বাঘ-বাড়ি। তবে এই রাজবাড়িটি ভগ্নাবশেষ আকারেই রয়েছে। গ্রামবাসীরা বলেন এই রাজবাড়ির প্রবেশদ্বারে দুটি ব্রিটিশ সময়ের তৈরি সিংহের উপস্থিতির কারণেই এমন নামকরণ হয়েছে। তবে অনেকেই বলেন এই রাজবাড়িটি চৌধুরীদের নয়। পরবর্তীকালে জনৈক মুখোপাধ্যায় এখানে বসবাস করতেন। কিন্তু এই মুখোপাধ্যায়রা কে ছিলেন, রাজা ছিলেন নাকি জমিদার, তা নিয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

 

AmadpurRajbari5

তবুও আগাছা আর অতীতের গন্ধ মেখে এই অজ্ঞাত প্রাসাদটি আমাদপুরে বর্তমান

হেরিটেজ হোম স্টে হিসেবে আমাদপুর রাজবাড়িটি মোটামুটি পরিচিত। কিন্তু ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে তেমনভাবে আধুনিকীকরণ হয়নি এই রাজবাড়ির। তবে একসময় মনুষ্যবর্জিত একটি প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে আজকের আমাদপুর হয়ে ওঠার নেপথ্যে রয়েছে চৌধুরী জমিদার ও তাঁদের তৈরি জমিদারবাড়ি ও রাজবাড়ি।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...