সবুজ ঘাসের চাদর মেলা পথ। ঠিক স্বপ্নের মত। মাঝে এবড়ো-খেবড়ো রাস্তা যেন বাস্তবের প্রতিচ্ছবি। ঘাস বিছানো রাস্তা পেরোলেই সুবিশাল রাজবাড়ি। একেবারে জনমানসবিহীন নয়। রাজবাড়ির উত্তর পুরুষেরা থাকেন এখানেই। আসলে এই রাজবাড়ির জন্মভূমি যে সবুজের সমারোহে উজ্জ্বল। রাজবাড়ি থেকে চোখ মেললে দেখা যায় চা বাগান। নিউ জলপাইগুড়ি। এই শহরের অন্যতম আকর্ষণ বৈকন্ঠপুর রাজবাড়ি।
প্রসন্নদেব রায়কত ছিলেন এই পরিবারের শেষ রাজা। তাঁর মৃত্যুর পর সেই অর্থে রাজা হিসেবে আর কাউকে চিহ্নিত করা হয়নি। প্রসন্নদেব রায়তের একমাত্র কন্যা প্রতিভা বসুর ছোট ছেলে প্রণত কুমার বসু বর্তমানে এই রাজবাড়িতে থাকেন। ছেলে সৌম্য বসু ওঁর সঙ্গে থাকেন।
মন্দির বেষ্টিত রাজবাড়ি এই বৈকুন্ঠপুর রাজবাড়ি। মূলত বৈকুন্ঠনাথ অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণের বিগ্রহ পূজিত হয় বলেই এই রাজবাড়ির নাম বৈকুন্ঠপুর রাজবাড়ি। জন্মাষ্টমীর দিন বৈকুণ্ঠনাথের পুজো হয়। পুজো মূলত অনুষ্ঠিত হয় রাতে। পরের দিন সকালে নন্দ উৎসব হয়। বিশেষ দধি খেলা আয়োজন করা হয় এই পুজো উপলক্ষ্যে।
বৈকুন্ঠপুর রাজবাড়ির দুর্গাপুজো বিখ্যাত। জন্মাষ্টমীর দিন মা দুর্গার প্রতিমা ও কাঠামো তৈরি হয় রাজবাড়ির রথের ওপর।
বৈকুন্ঠপুর রাজবাড়ি আরেকটি কারণে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এটি একমাত্র রাজবাড়ি যেখানে দেবী মনসার পুজো মহা আড়ম্বরে অনুষ্ঠিত হয়। সাত দিনব্যাপী মেলা চলে।
মহালয়ার পরদিন মা দুর্গার ঘট প্রতিষ্ঠা করা হয়। তারপর থেকে পরপর ন’দিন মায়ের পুজো করা হয়। নবরাত্রি হিসেবে ধরা হয় ওই নটি দিন। মায়ের মন্দিরে হয় সেই পুজো। এখানে মা তপ্ত কাঞ্চনবর্ণা। এই রাজবাড়িতে দুর্গাপুজো হয় কালিকাপুরাণ মতে। মায়ের সঙ্গে কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতী, জয়া, বিজয়া, ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর, মহামায়া ও মা চন্ডী থাকেন। পুজোর নানান সামগ্রী আসে বাংলাদেশ থেকে। সমস্ত দেব-দেবীকে সোনার গহনা পরানো হয়। দেবীকে সজ্জিত করা হয় রুপোর তৈরি অস্ত্র দিয়ে।
হাঁস, পায়রা , চালকুমড়ো, আখ, বাতাবি লেবু বলি দেওয়া হয় দুর্গাপুজোর চার দিনব্যাপী। বৈকুন্ঠপুর রাজবাড়ির রথ বিখ্যাত। প্রতিমা বিসর্জনের দিন মা বাপের বাড়ি থেকে শ্বশুরবাড়ি পাড়ি দেন রথে। দুর্গার সঙ্গে তখন কার্তিক, গণেশ, বাঘ, সিংহ থাকেন। ওই রথ টানার জন্য সহজ ও তার আশেপাশের এলাকা থেকে ভিড় হয় রাজবাড়িতে।
রাজবাড়ির দীঘিতে পদ্মফুল ফুটে থাকে। এই দীঘিতে পদ্মফুল নিয়মিত ফোটে। এক কথায় এই রাজবাড়িতে এখনও পদ্মদীঘি বর্তমান।
এই রাজবাড়ি বিখ্যাত এর স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের জন্যেও। মা মনসার মন্দির ও শিবের মন্দির রয়েছে। পাশে রয়েছে ছোটদের খেলার জন্য পার্ক। মন্দিরের কারুকার্য অত্যন্ত সুন্দর। রাজবাড়ির দিঘীটি স্বাভাবিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়। দিঘীর চারপাশে সুন্দর, বাঁধানো বসার জায়গা রয়েছে।
রাজবাড়ির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অংশ হল তার প্রবেশদ্বার। এটি গম্বুজাকৃতি। প্রবেশদ্বারটি নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের দিক থেকে এখনও বেশ উজ্জ্বল। রাজবাড়ির এই প্রবেশদ্বারের নাম গিনেস বুকে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রবেশদ্বারটি তৈরি হওয়ার দিক থেকে অনন্য। সৌন্দর্য ও এই অনন্যতার জন্যেই গিনেস বুকে নাম রয়েছে এই রাজবাড়ির প্রবেশদ্বার।
শুধুমাত্র চুন, সুরকি, ইট দিয়ে তৈরি এই প্রবেশদ্বার। এখানে নেই কোন লোহার রড। অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে উনবিংশ শতাব্দীর শুরুর মধ্যে তৈরি হয়েছিল এই রাজবাড়ি। সেই সময়কাল হিসেবে প্রযুক্তির দিক থেকে অন্যতম দ্রষ্টব্য হিসেবে উল্লেখ্য এই রাজবাড়ি। জলপাইগুড়ির অন্যতম দর্শনীয় স্থান হিসেবে বৈকন্ঠপুর রাজবাড়িকে আজও ধরা হয়। তবে মূলত উৎসবের সময়ই জনসমাগম হয় এখানে। বাকি দিনগুলিতে স্মৃতি আর অতীত বুকে নিয়ে একলা পথের মত কিছু উত্তরপুরুষদের বসবাসের স্থান হিসেবে টিকে রয়েছে এই রাজবাড়ি।