সময়টা অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি। তখন অবিভক্ত বাংলা। নবাবদের রাজত্ব চলছে। জমিদারি প্রথায় জীবন-যাপন করছেন সাধারণ মানুষ। এই সময় জামালপুর পরগণার জমিদার ছিলেন শেখ ইনায়েতউল্লাহ। তিনি এই জায়গাটিতে রংমহল নামে একটি প্রমোদ ভবন তৈরি করেন। নিজের জমিদারির মধ্যেই আনন্দ উদযাপনের ব্যবস্থা করেছিলেন জমিদার। এদিকে উদ্দাম জীবনযাপন, আর্থিক সামর্থ্যের বাইরে কাটানো জীবন পরবর্তীকালে বিপদে ফেলেছিল তাঁক ছেলে শেখ মতিউল্লাহকে। তাই শেখ মতিউল্লাহ রংমহল বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন। ফরাসি বণিকদের কাছে তিনি এই সুবিশাল প্রাসাদ বিক্রি করে দিয়েছিলেন। ফরাসিরা মূলত বানিজ্য কেন্দ্র হিসেবেই ব্যবহার করতে শুরু করে এই বিশাল প্রাসাদ। সে সময় বাণিজ্য কুঠি হিসেবে 'রংমহল' বেশ পরিচিত ছিল।
রংমহল তখন পরিচিত স্থাপত্য। তার বাহারি সৌন্দর্য আকর্ষণীয় ছিল সকলের কাছে। অনেক নবাব, রাজাদের নজর ছিল এই প্রাসাদের প্রতি। এর ফল দেখা গেল কিছুদিনের মধ্যেই।
১৮৩০ সালে নবাব আব্দুল গণির বাবা খাজা আলিমুল্লা 'রংমহল' কিনে নিয়ে বসবাস করা শুরু করেছিলেন। নবাব আব্দুল গণি তাঁর প্রিয় 'রংমহল'কে নতুন করে সাজানোর পরিকল্পনা করেন। মার্টিন এন্ড কোম্পানি নামের একটি ইউরোপিয়ান আর্কিটেকচারাল কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন নবাব। এই কোম্পানির তত্ত্বাবধানে খোলনলচে বদলে যায় রংমহলের। পুরনো স্মৃতির গায়ে প্রলেপ পড়ে নতুনের। মার্টিন এন্ড কোম্পানি নতুন, বিশেষ প্ল্যান তৈরি করে দেয় রংমহল গড়ে তোলার জন্য। সেই মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী ১৮৫৯ সালে নবাব বর্তমান প্রাসাদটি নির্মাণ শুরু করেন, যা ১৮৭২ সালে শেষ হয়। নবাবের ছেলে খাজা আহসানুল্লাহর নামানুসারে ওই নতুন ভবনের নাম রাখা হয় 'আহসান মঞ্জিল'। এক যুগ স্মৃতি পার করে জন্ম নেয় আহসান মঞ্জিল। রংমহল নতুন রঙে সেজে উঠে তৈরী হয় ঢাকার বিখ্যাত আহসান মঞ্জিলে।
রংমহল থেকে আহসান মঞ্জিল হয়ে ওঠার পথ তেমন কঠিন ছিল না। কিন্তু আসল লড়াই শুরু হয় এর পরে। আর সেই অসম লড়াই ছিল প্রকৃতির বিরুদ্ধে। ১৮৮৮ সালে প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে আহসান মঞ্জিলের প্রচুর ক্ষতি হয়। প্রয়োজন হয়ে পড়ে পুনর্নির্মাণের। ঢাকার নবাবের অত্যন্ত প্রিয় প্রাসাদ ছিল এই আহসান মঞ্জিল। তাই পুনর্নির্মাণের সময় আবার তাকে সাজানোর প্রচেষ্টা চলে। বর্তমানে এই আহসান মঞ্জিলে দেখতে পাওয়া উঁচু গম্বুজটি তখন সংযোজন করা হয়। এরপর ১৮৯৭ সালে ভূমিকম্পে আবারো ক্ষতিগ্রস্ত হয় আহসান মঞ্জিল। ঝড় যেটুকু ক্ষতি করতে পারেনি তার অনেকটাই ক্ষতি হয়ে যায় ভূমিকম্পে। দক্ষিণের বারান্দাসহ ইসলামপুর রোড সংলগ্ন নহবতখানা সম্পূর্ণরূপে ভেঙে পড়ে। নবাব আহসানুল্লাহ তা পুনর্নির্মাণ করেন। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে নবাবদের প্রিয় হিসেবেই টিকে থেকেছে এই প্রাসাদ।
ঢাকার এই আহসান মঞ্জিল প্রথম ইট, পাথরের তৈরি স্থাপত্য। জনদরদী নবাব আব্দুল গনি প্রায় আড়াই লাখ টাকা খরচ করে প্রথম জলবিশুদ্ধিকরণের জন্যে কল স্থাপন করেছিলেন এই আহসান মঞ্জিলে। ১৯০১ সালের আগে ঢাকায় বিদ্যুতের ব্যবস্থা ছিল না। প্রায় সাড়ে চার লাখ টাকা ব্যয় করে ঢাকার এই ভবনে প্রথম আলো জ্বলে।
আহসান মঞ্জিল একটি দোতলা ভবন। ছাদের ওপরের গম্বুজ এবং সুবিশাল চওড়া সিঁড়ি আহসান মঞ্জিলকে তার অনন্যতা দিয়েছে। এক সময় এই প্রাসাদের গম্বুজের চূড়াটি ছিল ঢাকা শহরের সবচেয়ে উঁচু চূড়া।
আহসান মঞ্জিলের স্থাপত্য শৈলীর অন্যতম আকর্ষণীয় অংশ হল এর পূর্ব ও পশ্চিম পাশের দুটি মনোরম খিলান। মার্বেল পাথরের মেঝে এই প্রাসাদের শোভা বাড়ায়। প্রতিটি কক্ষের আকৃতি আটকোণা।
স্থাপত্য দুইটি প্রধান অংশে বিভক্ত। পূর্ব ও পশ্চিম। দোতলার পূর্ব অংশে পাঠাগার ও বৈঠকখানা আর পশ্চিমাংশে নাচঘর ও অন্যান্য আবাসিক কক্ষ রয়েছে। নিচের অংশে দরবার কক্ষ ও ভোজন কক্ষ রয়েছে। সুপরিকল্পিতভাবে তৈরি করা হয়েছিল এই আহসান মঞ্জিল।
দরবারকক্ষটি সাদা, সবুজ ও হলুদ পাথরের তৈরি। আহসান মঞ্জিলের দোতলা থেকে একটি সুপ্রশস্ত সিঁড়ি বুড়িগঙ্গা নদীর ধারে নেমে গেছে। এই প্রাসাদের স্থাপত্য সব সময়ই আকর্ষণীয় ছিল। বড়লাট নর্থব্রুক ঢাকায় এসে এই প্রাসাদে সান্ধ্য অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন। লর্ড ডাফরিন, লর্ড কার্জনের অত্যন্ত প্রিয় স্থান ছিল এই আহসান মঞ্জিল।
তবে এই আহসান মঞ্জিল নেহাতই শুধু স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের দিক থেকে অন্যতম উল্লেখ্য ছিল না। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে প্রায় ১০০ বছর ধরে এই প্রাসাদ বাংলার প্রধান রাজনৈতিক কেন্দ্র ছিল। নবাব পরিবার ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলন ও রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। ভূমিকা পালনের শুরু হয়েছিল আহসান মঞ্জিল থেকেই।
১৯৫২ সালে জমিদারি বিলোপ আইনে সরকার নবাবদের সম্পত্তি অধিগ্রহণ করে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে স্বাধীন হওয়ার পরে নবাব পরিবারের অধিকাংশ উত্তরাধিকারী বিদেশে পাড়ি দেন। তখন নবাবের পরিবারের পক্ষে এই সুবিশাল প্রাসাদ রক্ষণাবেক্ষণ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। তারা এই ভবন বিক্রি করে দেওয়ার প্রস্তাব দেয়। স্থির হয়েছিল আহসান মঞ্জিল নিলামে উঠবে। কিন্তু সেই সময় প্রধানমন্ত্রী ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। তিনি ১৯৭৪ সালে এর নিলাম প্রস্তাব বাতিল করে।
১৯৮৫ সালে সরকার আহসান মঞ্জিল অধিগ্রহণ করে। পরবর্তীকালে নবাব পরিবারের স্মৃতি বিজড়িত এই প্রাসাদ বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের তত্ত্বাবধানে জাদুঘর হিসেবে পরিচালিত হচ্ছে। মোট ৩১ টি কক্ষ বিশিষ্ট যাদুঘরের মধ্যে ২৩ টি কক্ষ প্রদর্শনীর জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে। প্রায় সমস্ত পুরনো জিনিসপত্রই সংরক্ষিত রাখা রয়েছে এখানে। পর্যটকদের নিয়মিত ভিড় হয় আহসান মঞ্জিলে। হাত বদল, যুদ্ধ, পারিবারিক লড়াই সবকিছু সাক্ষী থেকেছে এই সুবিশাল ঐতিহ্যশালী প্রাসাদ।