পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে একা রামমোহন

১৮১৯ খ্রিস্টাব্দ। কলকাতায় মহা আলোড়ন পড়ে গেল। মাদ্রাজের সুবিখ্যাত বেদজ্ঞ পণ্ডিত সুব্রহ্মণ্য শাস্ত্রী এসেছেন। তিনি এসেছেন রাজা রামমোহন রায়কে তর্কযুদ্ধে পরাস্ত করতে। শুধু তাই নয়, তিনি দর্পভরে ঘোষণা করলেন যে, বাংলায় প্রকৃত বেদজ্ঞ কেউ নেই, তাই রামমোহন বেদ-বেদান্তের দোহাই দিয়ে নিজের মত প্রচার করছেন! তিনি রামমোহনকে যুক্তিজালে পরাস্ত করে প্রমাণ করে দেবেন যে, মূর্তিপূজাই হল শ্রেষ্ঠপূজা, প্রাচীন শাস্ত্রে তাকেই মান্যতা দেওয়া হয়েছে।

আসলে, রামমোহন এই সময় নিরাকার উপাসনার কথা প্রবলভাবে প্রচার করছিলেন। মূর্তিপূজার বিরোধিতা করছিলেন। এবং তার জন্য বেদ-বেদান্তের বচন তুলে তিনি মানুষের কাছে তুলে ধরছিলেন যে, হিন্দুধর্মের প্রাচীন শাস্ত্রে মূর্তি নয়, নিরাকার উপাসনার কথাই বলা হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই তাঁর এই প্রচার, প্রথায় যারা বিশ্বাস রাখেন তেমন মানুষ এবং যারা ধর্ম-ব্যবসায়ী তাঁদের পছন্দ হচ্ছিল না। ফলে, তাঁরা নানাভাবে রামমোহনকে আক্রমণ করছিলেন কখনও খেউড়-মার্কা ছড়া লিখে, যেমনঃ

‘সুরাই মেলের কুল,

বেটার বাড়ি খানাকুল,

বেটা সর্বনাশের মূল,

ওঁ তৎসৎ বলে বেটা বানিয়েছে স্কুল;

ও সে জেতের দফা, করলে রফা

মজালে তিন কুল।’

অন্যদিকে ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ‘সংবাদ চন্দ্রিকা’ পত্রিকা প্রকাশ করে তাঁর বিরুদ্ধে লেখালেখি শুরু করেছিলেন। আক্রমণাত্মকভাবে রামমোহনের মত খণ্ডন করে গৌরীকান্ত ভট্টাচার্য নামের এক ভদ্রলোক ‘জ্ঞানাঞ্জন’ নামে একটি বই লিখে ও ছাপিয়ে সাধারণের মধ্যে প্রচার চালাতে শুরু করেন। বিরুদ্ধতার এমন উদাহরণ অনেক আছে।

যাই হোক, ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে শাস্ত্রব্যাখ্যা ও বিচারের জন্য একটি সভা গঠন করেন রামমোহন। নাম দেন, ‘আত্মীয় সভা’। এতে সাধারণ থেকে শুরু করে শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত সকলেই যোগ দিতে পারতেন শাস্ত্র আলোচনার জন্য। তবে ইতোমধ্যে রামমোহন শুধু যে এভাবে সভা-সমিতি করে মুখে মুখে নিজের মত প্রচার করেছেন এমন নয়, শাস্ত্রীয় প্রমাণ যাতে মানুষ স্বচক্ষে দেখতে পারেন, সেই জন্য তার ওপর বাংলায় গ্রন্থও লিখে ফেলেছিলেন। যথা, ‘বেদান্তদর্শনের অনুবাদ’ (১৮১৫ খ্রিস্টাব্দ), ‘বেদান্তসার’, ‘কেন ও ঈশোপনিষদের অনুবাদ’ (১৮১৬), ‘কঠ, মুণ্ডক ও মাণ্ডুক্যোপনিষদের অনুবাদ’, ‘হিন্দু একেশ্বরবাদ সম্বন্ধীয় গ্রন্থ’ (১৮১৭), ‘সতীদাহ সম্বন্ধীয় বিচার পুস্তক’, ‘বৈষ্ণব গোস্বামীর সহিত বিচার পুস্তক’, ‘গায়ত্রীর ব্যাখ্যা পুস্তক’ (১৮১৮)। বস্তুত, এর ফলে প্রথাপন্থীরা তাঁর প্রতি আরও ক্ষেপে গিয়েছিল এবং তাঁর অনুবাদ ভুল, তাঁর ব্যাখ্যা অশিক্ষিতের ব্যাখ্যা, এটা প্রমাণ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। যদিও তাঁর সংস্কৃতজ্ঞান সম্পর্কে কারও সংশয়ের অবকাশ থাকার কথাই ছিল না; কেননা, তিনি দীর্ঘকাল কাশীতে অবস্থান করে সেখানকার বিখ্যাত পণ্ডিতদের কাছে সংস্কৃত অধ্যয়ন করেছিলেন।

যা বলছিলাম, দক্ষিণ ভারতীয় বেদজ্ঞ পণ্ডিত সুব্রহ্মণ্য শাস্ত্রী এসে যখন কলকাতার বুকে আপন বিদ্যের বড়াই করে রামমোহনকে পরাস্ত করার হুঙ্কার ছেড়ে তর্কযুদ্ধে আহ্বান জানালেন; তখন সমগ্র কলকাতা একেবারে নড়েচড়ে উঠল। রামমোহনপন্থীরা কৌতূহলী হলেন, প্রথাপন্থী হিন্দুরা আশায় বুক বেঁধে দারুণ উৎসাহিত হয়ে উঠলেন। নির্দিষ্ট দিনে আয়োজিত হল সেই তর্কযুদ্ধ। আসর হল বিহারীলাল চৌবে নামে এক প্রবাসী ব্রাহ্মণের বাড়িতে। প্রথাপন্থী ও রামমোহনবিরোধী দলের নেতা রাধাকান্ত দেব রামমোহনের পরাজয় নিশ্চিত জেনে সদলে সেই সভায় হাজির হলেন রঙ্গ দেখতে। দলে দলে দর্শক হয়ে এলেন তাঁর অনুগামীরা, অসংখ্য রামমোহনপন্থীরাও এসে যোগ দিলেন। কলকাতার বাকি ধর্ম-উৎসাহী মানুষেরাও এলেন দলে দলে। ফলে আসরে তিলধারণেরও আর জায়গা রইল না।

তর্কযুদ্ধের শুরুটা হল রামমোহনপন্থী কয়েকজন ব্রাহ্মণের সঙ্গে তর্কের মধ্য দিয়ে, তারপর তাতে যোগ দিলেন রামমোহন। শিবনাথ শাস্ত্রী তাঁর 'রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’ গ্রন্থে এই তর্কযুদ্ধের যে বর্ণনা দিয়েছেন তা হলঃ "বৈদিক-শাস্ত্র-জ্ঞানবিহীন দেশীয় ব্রাহ্মণগণ সুব্রহ্মণ্য শাস্ত্রীর সমক্ষে হাঁ করিতে পারিলেন না। কেবল রামমোহন রায়ের সহিত সমানে সমানে বাগযুদ্ধ চলিল। তুমুল শাস্ত্রীয় বিচারের পর শাস্ত্রী পরাভব স্বীকার করিলেন; নিরাকার ব্রহ্মোপাসনাকে শ্রেষ্ঠ উপাসনা বলিয়া স্বীকার করিতে বাধ্য হইলেন। ‘রামমোহন রায় সুব্রহ্মণ্য শাস্ত্রীকে বিচারে পরাস্ত করিয়াছেন’, এই বার্তা যখন তাড়িত বাত্ত্যার নায় সহরে ব্যাপ্ত হইল, তখন তাঁহার বিপক্ষগণের ক্রোধ ও আক্রোশ দশগুণ বাড়িয়া গেল।’

পনের শতকে বাংলার এক ধর্মসংস্কারক নিমাই পণ্ডিত আরেক পাণ্ডিত্য-অভিমানী কেশব ভারতীকে পরাস্ত করে আপন জ্ঞানের জয়ধ্বজা উড়িয়েছিলেন; উনিশ শতকে ধর্মসংস্কারক রামমোহনের জীবনে তারই যেন অনুর্বর্তন ঘটল। জয় স্বাভাবিকভাবেই তাঁর প্রতি আরও ক্রোধ, আরও বিদ্বেষ বয়ে আনল।

অবশ্য ক্রোধ-বিদ্বেষের এই প্রবাহ তাঁর জীবনে নতুন নয়। তাঁর যখন ন’দশ বছর বয়স, তখন তাঁর বাবা রামকান্ত তাঁকে ফারসি ও আরবি শেখানোর জন্য পাটনা পাঠান। কেননা, সেকালে চাকরিক্ষেত্রে এই দুটি ভাষার যথেষ্ট মূল্য ছিল। বিভিন্ন ধর্মের ধর্মগ্রন্থের প্রতি রামমোহনের প্রবল অনুরাগ ছিল। তাই ভাষা দুটি শিখেই তিনি কোরআন পাঠ শুরু করেন। এই ধর্মগ্রন্থ পাঠ করেই প্রতিমাপূজার ওপর তিনি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েন। এবং পৌত্তলিকতার বিরোধিতা করার ষোল বছর বয়সেই একখানা গ্রন্থ রচনা করে ফেলেন। গ্রন্থ প্রকাশের পর হিন্দু সমাজের মাথারা তাঁর প্রতি অসম্ভব বিরক্ত হয়ে শুরু করেন সামাজিক বয়কট। পৌত্তলিকতার প্রতি রামমোহনের বিরোধিতা বাবাও সহ্য করেননি, তাঁকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেন।

বাড়ি থেকে বেরিয়ে রামমোহন সন্ন্যাসীদের সঙ্গ নিয়ে তিব্বতে পৌঁছন। সেখানে গিয়ে দেখেন বৌদ্ধরাও মূর্তিপুজোয় মত্ত। তাদের সেই মতের বিরোধিতা করায় তারা তাঁকে হত্যা করতে উদ্যত হয়। কয়েকজন তিব্বতী রমণীর দয়া ও সাহায্যে সেখান থেকে প্রাণ বাঁচিয়ে ফিরে আসতে সক্ষম হন।

তিব্বত থেকে আসেন কাশী। কাশীতে এসে সংস্কৃত শিখতে শুরু করেন। তারপর বেদ-বেদান্ত পাঠ করে দেখেন যে, সেখানেও নিরাকার দৈব উপাসনার কথাই বলা হয়েছে। তাতেই তাঁর বিশ্বাসের ভিত্তিভূমি আরও সুদৃঢ় হয়ে ওঠে। পৌত্তলিকতার বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে রামমোহন শুধু যে হিন্দু বা বৌদ্ধধর্মের প্রচলিত প্রথার বিরুদ্ধে কথা বলেছেন এমন নয়, খ্রিস্টের মূর্তিপূজার বিপক্ষে বলে শ্রীরামপুর মিশনারিদেরও বিরাগভাজন হন। এক সময় বাবা রামমোহনকে বাড়ি ফিরিয়ে আনেন। তখনও সমাজপতিরা গ্রামের বাড়িতে গরুর হাড় ছুঁড়ে দিনরাত মুরগির ডাক ডেকে বিরক্ত করার চেষ্টা চালাতে থাকে। বাবার মৃত্যুর পর মা আবার তাঁকে ত্যাগ করেছিলেন শুধুমাত্র ওই পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে নিজের অবস্থানে অনড় থাকার জন্যই।

আসলে, রামমোহনের মতো দৃঢ়চেতা স্বাধীনচেতা নির্ভীক ও অনমনীয় মানসিকতার মনীষী বাংলায় জন্মেছিলেন বলেই উনিশ শতক হয়ে উঠতে পেরেছিল নবজাগরণের কাল। জন্ম হয়েছিল প্রগতিশীল ব্রাহ্মধর্মের। রদ হয়েছিল সতীদাহের মতো জঘন্য অমানবিক প্রথার। দেশে হয়েছিল পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার। রামমোহন তাই শুধু আমাদের প্রণম্য নন, প্রাতঃস্মরণীয়ও...

 

ঋণ: 'রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ'- শিবনাথ শাস্ত্রী।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...