২৪৭তম জন্মদিনে আলোর দূত

১৭৭২ সালের ২২ মে, এই দিনেই জন্মগ্রহন করেছিলেন সমাজচিন্তার নবজাগরণের পুরোধা রামমোহন রায়। তাঁর মত মহান আত্মার ২৪৭তম জন্মদিন স্মরণ করা হবে সেটাই কাম্য কারণ, জ্ঞান আর মুক্তমন নিয়ে অন্ধকারকুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজের যাবতীয় গোঁড়া-শিকল ছিঁড়ে ফেলতে চেয়েছিলেন তিনি; শুধু তাই নয়, তাঁর এই চাওয়া নিরন্তর লড়াই চালিয়ে সার্থক করে তবেই ছেড়েছিলেন তিনি। তাঁর দেখানো আলোর পথেই আজ হাঁটছি আমরা।

তাঁর সময়ে আন্দোলন-লড়াই এসব অত সহজ কথা ছিল না, কারণ 'গনতন্ত্র'-এর মানে সেসময়ের জানা ছিল না, সমাজের বিরুদ্ধাচরণ ছিল মহাপাপ। সমাজ স্বঘোষিত সেই মহাপাপ যাঁরা করত তাঁরা সকলেই সমাজ থেকে বিতাড়িত হত শুধু তাই নয় তাঁদেরকে করে দেওয়া হত 'একঘরে'। ছোট ছোট মেয়েদের জলন্ত চিতার আগুনে পুড়িয়ে মারা হত, সেই সব বলি হওয়া প্রানের আকুতি পৌঁছেছিল তাঁর মনের গভীরে। চুপ থাকতে পারেননি তিনি। তাঁর মত মুক্তমনের মানুষদের একজোট করে, দীর্ঘদিন আন্দোলন-আলোচনা করে, নিজের বক্তব্যে অনড় থে্কে লর্ড বেন্টিঙ্কের সহযোগিতায় সারা ভারতবর্ষে নিষিদ্ধ করে দিতে পেরেছিলেন সতীদাহ প্রথার মত ঘৃন্য সামাজিক প্রথাকে। বহুবিবাহ প্রথার প্রতিও তিনি সোচ্চার হয়েছিলেন।

তার জন্য অনেক অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছিল তাঁকে। সতীদাহ প্রথা রোধ করার পর ১৮১৪ সালে তিনি গড়ে তোলেন 'আত্মীয়সভা'। তারপর তিনি লেগে পড়েন ধর্মসংস্কারের কাজে। সেকালে ধর্মের মধ্যে যেধরনের গোঁড়ামি ছিল, তা সংস্কারী-শিক্ষিত রামমোহনকে ভাবিয়ে তুলেছিল। ধর্মীয় সত্য অনুসন্ধানের তৃষ্ণায় তাঁর উদার মন নিয়ে সকল গুরুত্বপূর্ণ ধর্মের শাস্ত্রসমূহ অধ্যয়নে প্রণোদিত হন। এভাবে তিনি শুধু সংস্কৃত ভাষায় হিন্দু ধর্মশাস্ত্রসমূহ অধ্যয়ন করেই ক্ষান্ত হন নি; আরবি ভাষায় কোরান, হিব্রু ভাষা ও গ্রিক ভাষায় বাইবেল পাঠ করেন। বিভিন্ন ধর্ম অধ্যয়ন তাঁর মনে দৃঢপ্রত্যয় জন্মায় যে, যেহেতু প্রত্যেক ধর্মেরই উদ্দেশ্য অভিন্ন - মানব জাতির নৈতিক পুনর্জাগরণ, তাই পরিবর্তিত সময়ের প্রেক্ষাপটে প্রত্যেক ধর্মের পুনর্ব্যাখ্যা ও পুর্নমূল্যায়ন প্রয়োজন এবং এই চিন্তা করে তিনি দেখলেন যে, শুধু তাঁর পক্ষে নয়, কারো পক্ষেই নিজ-নিজ ধর্ম ত্যাগ করে অন্য কোনও ধর্ম গ্রহণের পেছনে কোন যুক্তি খাড়া করা যাচ্ছেনা। তিনি প্রত্যেক ধর্মের গোঁড়ামি, শাস্ত্রীয় আচারবিধি ও কুসংস্কার বাদ দিয়ে সর্বজনীন নৈতিক উপদেশাবলি তৈরী করেন। কিছুদিন যাবৎ অনেকটা অন্ধের মতো অবসন্ধানের পর তাঁর ধর্মীয় ধ্যান-ধারণা কিছুটা স্পষ্ট রূপ লাভ করে। ১৯ শতকের গোড়ায় ১৮২৮ সালের আগস্ট মাস নাগাদ রামমোহন রায় এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা মিলে সমাজ ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে এক আন্দোলনের নির্দশনস্বরূপ ব্রাহ্ম সভা (পরবর্তীসময়ে ব্রাহ্ম সমাজ) অর্থাৎ নিরাকার ঈশ্বরের সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন।

রাজনৈতিক চিন্তাভাবনার সূত্রে রামমোহন ছিলেন ভারতে আন্তর্জাতিক মনন ও আদর্শের প্রবক্তা। তিনিই প্রথম ভারতীয় যিনি ভারতের বাইরের নানা ঘটনার প্রতি আগ্রহ দেখিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে মানুষের ওপর নিপীড়নের বিরুদ্ধে মতামত জানিয়েছিলেন। সামাজিক ও ধর্মীয় আন্দোলন এবং বাংলার পুনর্জাগরণের পুরোধা হিসেবে তো বটেই, উপমহাদেশে জাতীয় চেতনার উন্মেষেও রামমোহন রায়ের প্রভূত অবদান ছিল। ১৮৩১ সালে মুঘল সাম্রাজ্যের দূত হিসেবে যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স ভ্রমণ করেন তিনি। ১৮৩৩ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর মেনিনিজাইটিসে আক্রান্ত হয়ে ব্রিস্টলে তাঁর জীবনাবসান হয়। মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় আকবরই তাঁকে 'রাজা' উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। হ্যাঁ, তিনি ছিলেন প্রকৃত অর্থে আলোর দূত, মুক্তমনের 'রাজা' রামমোহন রায়।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...