পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস শুধু আজকের সমস্যা না, আজ থেকে দেড়শ বছর আগেও তার নজির রয়েছে। এবং সেই ধাক্কায় ছাত্রদের যে ভবিষ্যতের মোড় ঘুরে যেত, তার নজিরও যথেষ্ট রয়েছে। আর সেই নজিরের অন্যতম উদাহরণ পণ্ডিত রাজেন্দ্রলাল মিত্র। কীভাবে? সেটাই বলছি:
কলিকাতা মেডিক্যাল কলেজের প্রথম দিকের ছাত্র রাজেন্দ্রলাল প্রথমে ডাক্তার হতে চেয়েছিলেন। বিলেত ফেরৎ ডাক্তার হবার সুযোগও অচিরে এসেছিল তাঁর হাতের মুঠোয়। কিন্তু বাবা জাত খোয়াবার ভয়ে ছেলেকে ছাড়লেন না।
সে যা হয় হল। পড়তে পড়তেও সৎ-মানুষ হওয়ার খেসারত তাঁকে দিতে হল। সকল অধ্যাপকদের প্রিয় এবং ভালো ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও কলেজের ভেতর একটি ঝামেলায় সত্যরক্ষার দায়ে মুখ বন্ধ রাখার অপরাধে সকলের বিরাগভাজন হলেন এবং কলেজ থেকে বহিষ্কৃত হলেন।
ডাক্তারি পড়া এভাবে অকালে ইতি হয়ে যাওয়ার পর রাজেন্দ্রলাল ঠিক করলেন যে আইন নিয়ে পড়বেন। সেকালে আইন-ব্যবসায়ীদেরও কদর বা আভিজাত্য কম ছিল না। যথাসময়ে ফাইনাল পরীক্ষা দিলেন। দারুণভাবে দিলেন। কিন্তু পরীক্ষা শেষ হতেই প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে যাওয়ার কেলেঙ্কারি হঠাৎ প্রকাশিত হয়ে পড়ল। এবং সে-কারণেই পরীক্ষা বাতিল হয়ে গেল। এই ঘটনায় পরীক্ষাব্যবস্থার প্রতি রাজেন্দ্রলালের মন এতটাই বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ল যে, পুনরায় পরীক্ষাগ্রহণের ব্যবস্থা হলেও তিনি আর পরীক্ষা দিলেন না।
যাই হোক, এরই পাশাপাশি দুটো ভিন্নধারার খাতে জীবনকে বইয়ে দিতে চেয়েও ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি তাঁর আজন্ম যে ভালোবাসা, তাকে তিনি কিন্তু লালন করতে ভোলেননি। মেডিক্যালের ছাত্র থাকা অবস্থাতেই তিনি একজন ইংরেজ শিক্ষকের কাছে ইংরেজি সাহিত্য অধ্যয়ন করেছিলেন। অন্যদিকে সেকালের নিয়ম অনুযায়ী ছোটবেলাতেই পাশাপাশি বাংলা ও ফারসি ভাষা বেশ ভালোরকমভাবেই আয়ত্ত করেছিলেন।
এবার আইনে জলাঞ্জলি দিয়ে তিনি একে একে সংস্কৃত, গ্রিক, ল্যাটিন, ফরাসি, জার্মান, হিন্দি, উর্দু ভাষাসমূহ দারুণভাবে আত্মস্থ করে ফেললেন। এভাবেই তিনি বহুভাষাবিদ হয়ে উঠলেন। অর্জন করলেন বিবিধ ভাষার সাহিত্য-সংস্কৃতিতে অগাধ পাণ্ডিত্য।
বিবিধ ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি এই যে ভালোবাসা, তা কিন্তু তিনি পেয়েছিলেন পিতার কাছ থেকেই। বিজ্ঞান ও সাহিত্যকে একই খাতে বইয়ে দেওয়ার যে শিক্ষা, তাও তিনি পেয়েছিলেন সেই পিতার কাছ থেকে। পিতা জনমেজয় মিত্র হলেন প্রথম বাঙালি, যিনি রসায়নশাস্ত্র পাঠ করে পাণ্ডিত্য অর্জন করেছিলেন। সেই সঙ্গে সংস্কৃত, ফারসি, উর্দু সাহিত্যেও ব্যুৎপত্তি অর্জন করেছিলেন। শুধু তাই নয়, উর্দুতে একখানা কাব্য লিখে সুখ্যাত হয়েছিলেন। সেই সঙ্গে বাংলায় আঠের পুরাণের সার সংকলন করে এবং প্রাচীন বাংলা গান সংগ্রহ করে বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছিলেন।
পিতার ধারাতে ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসা রাজেন্দ্রলাল পেলেও তাকে জীবনের একমাত্র অবলম্বন করে আঁকড়ে ধরার ব্যাপারটি ঘটেছিল তাঁর জীবনে ঘটে যাওয়া একটি দুর্বিষহ ঘটনা থেকেই। তাঁর যখন মাত্র বাইশ বছর বয়স, তখন তাঁর স্ত্রী সৌদামিনী একটি কন্যাসন্তানের জন্ম দিয়ে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তারপর এক সপ্তাহের ব্যবধানে মা ও মেয়ে দুজনেই মারা গেলেন। দুর্বিষহ এই শোক থেকে শান্তি পেতেই ভাষা ও সাহিত্যের গবেষণায় নিজেকে সম্পূর্ণরূপে নিয়েজিত করলেন রাজেন্দ্রলাল। সেখান থেকেই তা হয়ে উঠল তাঁর জীবনের প্ৰধান অবলম্বন।
এই সময় তিনি এশিয়াটিক সোসাইটিতে এসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ও লাইব্রেরিয়ান হিসেবে যোগদান করলেন। এই জ্ঞানের মন্দিরে যোগ দিয়েই রাজেন্দ্রলাল প্রাচীন পুঁথির তালিকা তৈরিতে মন দিলেন।
অচিরেই সোসাইটির পত্রিকায় সেই সব পুঁথি নিয়ে গবেষণামূলক প্রবন্ধ লিখে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। কৃতিত্ত্ব রাখলেন প্রভূত সংস্কৃত পুঁথি সম্পাদনার মধ্য দিয়ে গ্রন্থাকারে প্রকাশের।
এছাড়া স্কুল বুক সোসাইটি ও ভার্ণাকুলার লিটারেচার সোসাইটির উদ্যোগে শিশুপাঠ্য বাংলা পুস্তক রচনাতেও অবদান রাখলেন। সুললিত ভাষায় লিখলেন, 'প্রাকৃত ভূগোল', 'পত্র কৌমুদী', 'ব্যাকরণ প্রবেশ', 'শৈল্পিক দর্শন', 'মেবারের রাজেতিবৃত্ত', শিবজীর চরিত্র' প্রভৃতি।
এছাড়া, বাংলা ভাষায় প্রথম সচিত্র মাসিক পত্রিকা প্রকাশের কৃতিত্বও রয়েছে রাজেন্দ্রলালের। তাঁর সুযোগ্য সম্পাদনায় 'বিবিধার্থ সংগ্রহ' পত্রিকা উনিশ শতকের অসাধারণ একটি মননশীল পত্রিকা হয়ে উঠেছিল। পত্রিকাটিকে তিনি 'পুরাবৃত্তেতিহাস- প্রাণীবিদ্যা- শিল্পসাহিত্যাদিদ্যোতক মাসিক পত্র' হিসেবে সিদ্ধির শিখরে পৌঁছে দিয়েছিলেন। সেকালের অনেক বিখ্যাত সাহিত্যিককেই এই পত্রিকার মাধ্যমে বাংলার পাঠকের দরবারে প্রথম হাজির করানোর কৃতিত্ব তাঁর। স্মরণীয় যে, এই পত্রিকার পাতাতেই 'তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য' লিখে মধুসূদন বাংলা কাব্য জগতে আবির্ভুত হয়েছিলেন।
সামাজিক প্রগতিশীল কাজেও রাজেন্দ্রলালের অবদান কম ছিল না। উনিশ শতকের পাঁচ ও ছয়ের দশকের সমস্ত রাজনৈতিক, সামাজিক, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক সভা-সমিতিতে ঠোঁট কাটা সুবক্তা হিসেবে রাজেন্দ্রলালের উজ্জ্বল উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। ভূমি সংক্রান্ত আইন প্রণয়নে অংশ নেওয়া থেকে শুরু করে কুখ্যাত ইলবার্ট বিলের বিরোধিতা, বিধবাবিবাহ আইন প্রচারে, বাল্য ও বহুবিবাহ রোধে বিদ্যাসাগরের পাশে প্রবলভাবে দাঁড়িয়ে দায়িত্বশীল মানুষ হিসেবে যথেষ্ট ও দীর্ঘমেয়াদি অবদান তিনি রেখেছিলেন। তাঁর এই সব অবদান অবশ্য আমরা ভুলে গেছি, জন্মের দুশো বছর পেরিয়ে তিনি আজ আমাদের কাছে শুধুই অজস্র কৃতী অথচ বিস্মৃত বাঙালির একজনমাত্র...