ভারতীয় চলচ্চিত্রের প্রবাদপ্রতিম সুরস্রষ্টা রাইচাঁদ বড়াল

মহিষাসুরমর্দিনী বলতেই আমাদের যেকয়টি নাম মনে আসে, তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন রাইচাঁদ বড়াল। সঙ্গীত পরিচালক অনিল বিশ্বাস কথায়, ভারতীয় চলচ্চিত্রে সঙ্গীতের “ভীষ্ম পিতামহ” তিনি। আজ যে আমরা এত ছায়াছবির গান শুনি তার জন্মদাতা কিন্তু রাইচাঁদই, সত্যিই আক্ষরিক অর্থেই তাই! তিনি ছিলেন ভারতীয় চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক সঙ্গীতের জনক। রাইচাঁদ বড়াল যখন পেশাদার সঙ্গীত জীবন শুরু করেন, তখনও ভারতীয় চলচ্চিত্রে গানের প্রচলন হয়নি। তিনিই প্রথম ছায়াছবির মধ্যে গানের প্রচলন করেন। ১৯৩৫ সালে মুক্তি পাওয়া হিন্দি সিনেমা ‘ধুপছাও’ ছবিতে একটি গান করেছিলেন রাইচাঁদ। ওটাই ছিল হিন্দি সিনেমার প্রথম প্লেব্যাক। আজ ২৫ নভেম্বর বিশ্ববরেণ্য এই সঙ্গীতজ্ঞের চলে যাওয়ার দিন। ১৯৮১ সালে আজকের দিনেই মৃত্যুবরণ করেছিলেন তিনি।

 

১৯০৩ সালের ১৯ অক্টোবর কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন এই দিকপাল সংগীতজ্ঞ। প্রখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী লালচাঁদ বড়ালের কনিষ্ঠ পুত্র ছিলেন রাইচাঁদ বড়াল, বাবার কাছেই তাঁর সঙ্গীত শিক্ষার হাতেখড়ি। তাঁদের ১/১, প্রেমচাঁদ বড়াল স্ট্রিটের বাড়িটিই ছিল উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের পীঠস্থান। বাবা ছেলের জীবনে এক ঐতিহাসিক সমাপতন রয়েছে, রাইচাঁদের বাবা লালচাঁদ বড়াল সর্বপ্রথম গ্রামাফোন রেকর্ডে গান করার জন্য এগিয়ে এসেছিলেন। আর তাঁর ছেলে রাই বাংলা তথা ভারতীয় চলচ্চিত্রে প্রথম নেপথ্য সঙ্গীতের ব্যবহার প্রচলন করেন।

 

১৯২৭ সালের ২৬শে আগস্ট কলকাতায় ১ গাস্টিন প্লেসের বাড়িতে ভারতের দ্বিতীয় বেতার কেন্দ্রের উদ্বোধন হয়৷ নৃপেন মজুমদারের আহ্বানে সেই বছরেই কলকাতা বেতারে যোগ দিলেন রাইচাঁদ বড়াল, তিনি বেতারের সঙ্গীত বিভাগে দেখতেন।
তবে প্রথম প্লেব্যাকের চার বছর আগেই সিনেমায় সঙ্গীত পরিচালনা শুরু করেন রাইচাঁদ বড়াল। ১৯৩১ সালে তিনি সবাক চলচ্চিত্র ‘দেনাপাওনা'-তে সঙ্গীত পরিচালনা করেন। তারও আগে তিনি নির্বাক চলচ্চিত্রেও সঙ্গীত পরিচালনা করতেন।
১৯৩০-এ তিনি চলচ্চিত্রজগতে আসেন এবং নির্বাক ছবি 'চাষার মেয়ে'তে প্রথম সঙ্গীত পরিচালনা করেন।

 

এরপরে সবাকযুগে তিনি এক অসামান্য নজির গড়েন। এদেশের সিনেমার গানের বিবর্তনের নেপথ্য কারিগর ছিলেন তিনিই। নির্বাক ছবির যুগে ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ক্র্যাফ্ট-এর তৈরি ‘চোর কাঁটা’ ও ‘চাষার মেয়ে’ ছবিতে তিনি যন্ত্রসঙ্গীতের মাধ্যমে আবহসংগীত সৃষ্টি করেন যা ভারতীয় চলচ্চিত্রে বিপ্লব নিয়ে আসে। ১৯৩১ সালে কলকাতায় প্রথম ফিল্ম স্টুডিও, নিউ থিয়েটার্স প্রতিষ্ঠিত হয়, যার সঙ্গে সূচনালগ্ন থেকেই যুক্ত ছিলেন রাইচাঁদ বড়াল। বঙ্গসন্তান বীরেন্দ্রনাথ সরকারের হাতে গড়া, নিউ থিয়েটার্স তখন ভারতের ছবি তৈরির আঁতুড়ঘর।

 

Raichand1

 

পরিচালক দেবকী বসু থেকে নীতিন বসু, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় থেকে প্রেমেন্দ্র মিত্রের মতো লেখক, কে ছিলেন না সেখানে৷ ১৯৩১ সালে যখন রাইচাঁদ বড়াল যোগ দিলেন নিউ থিয়েটার্সে, বাংলা সিনেমা তখন সবাক হওয়ার পথে হাঁটছে৷ প্লেব্যাক তখনও শুরু হয়নি৷ নিউ থিয়েটার্সেরই প্রথম সবাক ছবি ‘দেনাপাওনা’৷ নিউ থিয়েটার্সের প্রায় ৪০টি চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালনাও করেছিলেন।

 

১৯৩২-এ মুক্তিপ্রাপ্ত 'চণ্ডীদাস' ছবিতে তিনি প্রথমবারের জন্য এদেশের সবাক ছবিতে আবহসঙ্গীতের প্রচলন করেন। সারা জীবনে প্রায় দেড়শোর ছায়াছবিতে সুর দিয়েছেন। ১৯৩৫-এ ফের বিপ্লব ঘটালেন রাইচাঁদ, নিউ থিয়েটার্সের শব্দযন্ত্রী মুকুল বসুর সাহায্যে নতুন পদ্ধতিতে নৃত্য ও গীতের রেকর্ডিং করে, ভাগ্যচক্র ছায়াছবিতে সংযোজিত করেলেন। যাকে আজ আমরা প্লেব্যাক বলি! আস্তে আস্তে সাবলম্বী হচ্ছিল ছায়াছবি! শ্যুটিংয়ের সময় গান রেকর্ডিং করার যে অসুবিধা হত, তার সমাধান হল।

 

নীতিন বসু পরিচালিত ছবি ভাগ্যচক্র, ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে দৃষ্টান্ত স্থাপন করল৷ রাইচাঁদ বড়াল বাংলা সিনেমার সঙ্গীতে প্লেব্যাকের সাফল্যের সঙ্গে প্লেব্যাকের প্রয়োগ করলেন৷ গানটি ছিল ‘মোরা পুলক যাচি তবু সুখ না মানি’। গানটি সমবেত সঙ্গীত, নেপথ্যে গেয়েছিলেন সুপ্রভা ঘোষ, পারুল ঘোষ এবং উমাশশী দেবী। ভারতে প্রথম কার্টুন চিত্রের নির্মাতা হিসাবেও তিনি স্মরণীয়। ওয়াল্ট ডিজনির অনুপ্রেরণায় ১৯৩৪-এ নিউ থিয়েটার্রসের ব্যানারে তিনি "পি ব্রাদার্স" প্রযোজনা করেন।

 

বাংলা চলচ্চিত্রে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের প্রয়োগেও ক্ষেত্রেও অন্যতম পথিকৃৎ রাইচাঁদই৷ নিউ থিয়েটার্সের সঙ্গীতপ্রধান ছবি 'চন্ডীদাস' ও 'বিদ্যাপতির' সাফল্য তাঁকে খ্যাতির শিখরে পৌঁছে দিয়েছিল৷ দুটি ছবিরই হিন্দিতেও হয়েছিল, যা সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে পৌঁছে দিয়েছিল রাইচাঁদকে৷ ১৯৩৭-এ সঙ্গীত নির্ভর ছবি বিদ্যাপতিও সঙ্গীতের ক্ষেত্রে এক মাইলফলক হয়ে রয়েছে, ই ছবির সুরকার ছিলেন তিনি।

 

কানন দেবীর স্মৃতিকথা থেকে জানা যায় যে, নজরুল ইসলামও যুক্ত ছিলেন “বিদ্যাপতির” সঙ্গীত রচনায় । ১৯৩৮-এ সাথী ছবিতে রাইচাঁদ বড়ালের সুরে কানন দেবী ও কুন্দনলাল সায়গলের দ্বৈত কন্ঠে রাগাশ্রয়ী গান “বাবুল মোরা নৈহর ছুটল যায়” আজও সিনেমা ও সঙ্গীতপ্রেমী মানুষদের আবিষ্ট করে রাখে৷ ১৯৫৩ সালে মুম্বাই চলচ্চিত্র জগতে পা রাখেন রাইচাঁদ বড়াল৷ ওই বছর থেকেই তিনি নিয়মিত হিন্দি সিনেমায় সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন। রাইচাঁদ মোট ৩৮টি হিন্দি ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন।

 

১৯৭৮ সালে রাইচাঁদ বড়াল ভারতীয় চলচ্চিত্রের সর্বোচ্চ সম্মান দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কারে ভূষিত হন, ঐ বছরই সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি পুরস্কারেও ভূষিত হন তিনি৷ রাইচাঁদ সৃষ্ট সুর পঙ্কজকুমার মল্লিক, কুন্দনলাল সায়গল,কৃষ্ণচন্দ্র দে, কানন দেবী, চন্দ্রাবতী দেবী, উমাশশী, পাহাড়ী সান্যাল প্রমুখ মহান শিল্পীর কণ্ঠে অমরত্ব পেয়েছে। ১৯৮১-এর আজকের দিনেই চিরদিনের জন্য থেমে যায় তাঁর সুর, তিনি পাড়ি দেন দিকশূন্যপুরে। শেষ হয় ভারতীয় সঙ্গীতের এই মহীরুহ সুরস্রষ্টার জীবন।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...