আর কেনোই বা নয়! সেখান থেকেই তো কুড়িয়েছেন জীবনের রসদ। সঞ্চয় করেছেন সাড়। তেরো বছর বয়সে পালান বাড়ি থেকে। পৃথিবী দেখবেন বলে।আবার সেই দূরন্ত কখনও হয়েছেন স্থির। করেছেন ফেরিওয়ালা, রেলের হেল্পার, কখনও রাঁধুনির কাজও। তখন কলকাতায়। শহরই তাঁকে রাজনীতি-সচেতন করে তুলল। বোঝালো বেঁচে থাকারও একটা লড়াই আছে। বীরসিংহ গ্রামের ছোট্ট ছেলেটার মতোন করে শিখতে লাগলেন ইংরাজী।
কেদারনাথ পাণ্ডে। রাহুল সাংকৃত্যায়ন। একজন পর্যটক, বৌদ্ধ সহ বিভিন্ন শাস্ত্রে সুপণ্ডিত। সর্বোপরি মার্কসীয় শাস্ত্রে দীক্ষিত। বৌদ্ধ দর্শনে অগাধ পাণ্ডিত্য উপহার দিয়েছে মহাপণ্ডিত এর উপাধি। চিনিয়েছিলেন বস্তুবাদের বিজ্ঞানসম্মত গ্রহণযোগ্যতা কেনো প্রাসঙ্গিক। হিন্দি ভ্রমণ সাহিত্যের জনক। ছোটোবেলাতেই হারান মাকে। পিতা সামান্য চাষী। গ্রামের পাঠশালাতেই হাতেখড়ি। উর্দু ও সংস্কৃতের প্রাথমিক শিক্ষা লাভ এখানেই।
কিন্তু চলতে চলতে হৃদয়ঙ্গম করেছেন আরও ভাষা। হিন্দি, উর্দু, বাংলা, পালি, সংস্কৃত, আরবি, ফারসি, ইংরেজি, তিব্বতি ও রুশ। অনতিদীর্ঘ তালিকা, নয়? জালিওয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকান্ড তাঁকে এনে দাঁড় করায় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মুখোমুখি। ভাবতে শুরু করেন কোনটা হবে তাঁর প্রতিবাদের ভাষা। ইংরেজ বিরোধী কার্যকলাপের অভিযোগে তিন বছরের কারাদণ্ড ভোগ হলো মাত্র। এই সময় সৃষ্টি করে ফেলেছেন কুরআন শরীফ এর সংস্কৃত অনুবাদ।
তখন ধর্মে বিভোর। শিখলেন পালি ভাষা। কারণ এবারে আকর্ষণ করেছেন স্বয়ং গৌতম বুদ্ধ। বৌদ্ধ ধর্মের খোঁজে বদলে ফেললেন নাম। বুদ্ধের পুত্র রাহুল হলেন। ‘সাংকৃত্যায়ন' অর্থে, আত্তীকরণ করে যে। জেল থেকে ছাড়া পেয়েই সোজা বিহার। ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ এর সঙ্গে কাজ শুরু করবেন। সেখান থেকে রাশিয়ায় বক্তৃতা হয়ে আবার দেশে। ছাঁদনাতলায়। কমলা নামক একজন নেপালি মহিলার সঙ্গে আবদ্ধ হলেন বিবাহ বন্ধনে। উপহার পেলেন দুই সন্তান।
সারা জীবন ছুঁটেই গেলেন। দুই বার পালিয়েছেন বাড়ি থেকে। সংস্কৃত পাঠ নিয়েছেন মঠে। আঞ্চলিক ভাষার বরও ছিল তেমন।ফটোগ্রাফি শিখে সকল তীর্থ-ক্ষেত্রে ভ্রমণ শুরু করেন। মাদ্রাজে থাকাকালীন শিখে ফেলেন তামিল। কাশ্মীর, কার্গিল পেরিয়ে পায়ে হেঁটে পৌঁছেছেন তিব্বতে। তিব্বতীয় ভাষা রপ্ত করলেন। রচনা করলেন তিব্বত-হিন্দী অভিধান। এরপর বিদেশ। পরপর শ্রীলংকা, জাপান, কোরিয়া, চায়না, রাশিয়া, তেহরান, বালুচিস্তান প্রভৃতি দেশ গুলি ছিল তাঁর তালিকায়।
প্রতিদিনের দিনলিপি থাকতো। সংস্কৃত ভাষায়। এটিই পরে আত্মজীবনী লেখার ইন্ধন যোগায়। মাতৃভাষা ভোজপুরী। লেখালেখি করতেন সংস্কৃতেই। মোট ৩৬টি ভাষা জানতেন। গোটা দেশ ঘোরার সুবাদে লিখতে পেরেছেন একাধিক বিষয়ে। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ‘ভোল্গা থেকে গঙ্গা '। এর জন্য সম্মুখীন হতে হয়েছিলো বিরোধীতার।
'মেরি জীবন যাত্রা’ বইয়ের ভূমিকায় বুদ্ধকে তাঁর শিক্ষক ও গুরু আখ্যা দিয়েছেন।
১৯৫৮ সালে সাহিত্য আকাদেমি সম্মান। ১৯৬৩ সালের পদ্মভূষণ প্রাপক।
১৮৯৩ সালের আজকের দিনে পদার্পন। উত্তর প্রদেশের আজমগড়ে।
আজীবন ভেবে এসেছেন একটা নদী। যেতে হবে অন্য পারে। নৌকো পেলেন। জলের মধ্যে থেকে থেকে বেরিয়ে এলো বিভিন্ন অভিমত। সবার কথা শুনলেন। কিন্তু গ্রহণ করেননি কাওকে।আপন ছন্দেই বাঁধন ছেঁড়া প্রাণ।