মধ্যযুগে মেয়েদের জীবন মসৃণ ছিল না। নানা কুসংস্কার, বঞ্চনা তাদের জীবনের পথের বাঁকে অপেক্ষা করে থাকতো। মেয়েদের পড়াশোনার অধিকার থাকলেও তার প্রয়োগ ছিল না মধ্যযুগে। এমনকী সেভাবে পড়াশোনা করার সুযোগও হতো না সকলের। তবুও তার মধ্যেও কিছু নারী দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন নিজেদের কাজ দিয়ে। তেমনই এক মধ্যযুগীয় মহিলা কবি রহিমুন্নিসা।
মধ্যযুগে মেয়েদের নিজেদের অন্তস্থলের সুখ-দুঃখের অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যম হয়ে উঠেছিল তাঁদের কলম। শব্দ আর ছন্দে তাঁরা সাজাতেন নিজেদের মনের কথা। রহিমুন্নিসাও নিজের মনের কথা বলার জন্য হাতে তুলে নিয়েছিলেন কলম। তাঁর সাহিত্যচর্চার শুরু হয়েছিল অনুবাদসাহিত্য দিয়ে।
দৌলত উজির বাহারাম খাঁর লাইলী মজনু আর মহাকবি আলাওলের পদ্মাবতী কাব্য অনুবাদ করেছিলেন এই প্রথিতযশা মহিলা কবি রহিমুন্নিসা।
এই মহিলা কবির ছোটবেলা কেটেছিল বাংলাদেশে। ছোট থেকেই পড়াশোনার প্রতি ভারী আগ্রহ ছিল ছোট্ট মেয়েটার।সুযোগ পেলেই বাবার কাছ থেকে জেনে নানান বই পড়ার চেষ্টা করতেন তিনি। তবে মধ্যযুগে মেয়েদের শিক্ষার পরিসর সেভাবে ছিল না। তার মধ্যেই রহিমুন্নিসা নিজের জন্যে শিখে নিয়েছিলেন বিভিন্ন কাব্যগ্রন্থের অনুবাদ করা। খুব অল্প বয়সে বিয়ের আগেই লাইলী মজনু এই কাব্যগ্রন্থটি তিনি অনুবাদ করেছিলেন।
চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী উপজেলার মেঘল গ্রামে বিয়ে হয় রহিমুন্নিসার। তাঁর স্বামীর নাম ছিল আহমদ আলী চৌধুরী। রহিমুন্নিসার শ্বশুরবাড়ি বনেদি পরিবার ছিলেন। তাঁর শ্বশুর ছিলেন হাটহাজারীর বিখ্যাত জমিদার জান আলী চৌধুরী।
মধ্যযুগীয় মেয়েদের জীবনের রীতি অনুযায়ী কম বয়সেই বিয়ে হয়ে যায় রহিমুন্নিসার। অনেকেই ভাবতে থাকেন, এত অল্প বয়সে এমন বনেদি পরিবারে বিয়ে হওয়ার ফলে হয়তো পড়াশোনার চর্চা চলে যাবে এই ছোট্ট মেয়েটার।
কিন্তু রহিমুন্নিসার জীবনে যা হল তা এর পুরো উল্টো। তাঁর শ্বশুরবাড়ি অর্থাৎ জান আলী চৌধুরীর পরিবার একটি প্রাচীন অভিজাত বংশের পরিবার ছিল। শিক্ষা, সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে এই বংশের মর্যাদা ছিল সমুন্নত। রহিমুন্নিসার স্বামী তাঁকে উদ্বুদ্ধ করতেন আরো কবিতা রচনায়। তিনি স্বামীর উৎসাহেই পদ্মাবতী কাব্যের অনুবাদ করেছিলেন।
স্বামীর সহযোগিতা রহিমুন্নিসাকে জীবনের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থটি অনুবাদ করায়। স্বামীর সহযোগিতায় অনুপ্রাণিত হয়ে রহিমুন্নিসা নিজের মনের কথা বলতেন শব্দে আর ছন্দে। স্বামীর প্রতি প্রশংসা করতে গিয়ে তিনি বলেছেন
"মোর প্রতি রসরাজ।
রসিক সমাজ, ব্রত ধর্ম কাজ,
উপেক্ষা না করে চিত।"
খুব ছোট বয়সেই রহিমুন্নিসা তাঁর বাবা আব্দুল কাদির শাহকে হারিয়েছিলেন। তবে তাঁর পরিবারে শিক্ষার সুযোগ হয়েছিল। পরিবারের মানুষ উদারমনা হওয়ায় শিক্ষার সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। আরবী, ফার্সি এবং সাহিত্যের শিক্ষা অর্জন করেছিলেন কবি রহিমুন্নিসা।
তাঁর দাদু মূলত ছিলেন বিহারের মুঙ্গের নিবাসী। পরবর্তীকালে তাঁদের পরিবার চট্টগ্রামে চলে আসে। কারবালার যুদ্ধের পর কবি রহিমুন্নিসার আদিপুরুষ বাগদাদ থেকে মুঙ্গেরে এসেছিলেন। তারপর তাঁর পিতামহ জংলি সাহা চট্টগ্রামে আসেন।
১৮৪৬ জন্ম হয়েছিল কবি রহিমুন্নিসার। মধ্যযুগে জন্ম নেওয়ার পরেও তিনি মনের দিক থেকে অসাম্প্রদায়িক এবং উদারমনা মানুষ ছিলেন। পারিবারিক অসাম্প্রদায়িক মনোভাব এবং উদারচেতনার প্রভাব ছিল রহিমুন্নিসার মধ্যে।
তবে নিজের মনের কথা কলমের মাধ্যমেই বলতে পারতেন তিনি। তাঁর কলমেও ফুটে উঠেছে উদার মানসিকতা এবং নারীদের সম্বন্ধে উচ্চ চিন্তাভাবনা। তাঁর কবিতায় কুসংস্কারবিরোধী মনোভাব বারবার ফুটে উঠেছে। মধ্যযুগের কবি হলেও রহিমুন্নিসার চিন্তাভাবনা ছিল উচ্চমানের। এখান থেকেই ধীরে ধীরে উত্তরণের পথে এগিয়েছিলেন তিনি। মধ্যযুগের সাহিত্যচর্চা করেও তিনি আধুনিক নারীদের জন্য সাহিত্যের ক্ষেত্রে দিগন্ত উন্মোচন করেছিলেন।