ছবি তৈরি করা শব্দ-বাক্স

একটা ঘর। লাল রংয়ের মেঝে। মাদুর পাতা। তার ওপর রাখা একটা কালো বাক্সের মতো যন্ত্র। নব ঘোরালেই শুরু শব্দ-বর্ষণ। সেসব শব্দেরা ছবি তৈরি করে। শ্রোতার মনে। নাটক, গান কখনো বা সাক্ষাৎকার। কখনো গুরুত্বপূর্ণ খবরের ঝুলি। এ যেনো সান্টা-ক্লজের ম্যাজিক ঝুলি। সারা বছরই পাওয়া যায়। নব ঘোরালেই ম্যাজিকের মতো বেরিয়ে আসে প্রিয় অনুষ্ঠান। নাম তার রেডিয়ো।

রেডিয়ো শুনলেই যার কথা ঝিলমিল করে ওঠে মনে, তার নাম আকাশবাণী। আকাশবাণী কলকাতা বা অল ইন্ডিয়া রেডিয়ো মানে নস্ট্যালজিয়ার সোঁদা গন্ধ।

সময়টা মোটামুটি নব্বই দশক। সকাল মানেই স্বাস্থ্য নিয়ে খুঁটিনাটি 'টিপস'। বেলা বাড়লেই নানা গ্রামীণ অনুষ্ঠানের ডালি। ঝিম ধরানো দুপুরগুলোয় মহিলাদের বিষয়ে নানা অনুষ্ঠান। কখনো বা দুপুর সাজানো থাকত নাটকে। ঘোষক বা ঘোষিকার কণ্ঠস্বর তাঁর প্রিয় শ্রোতার কানে এবং মনে ঝড় তুলত। বিকেল হলেই খেলাধুলার অনুষ্ঠান। এমনই রঙিন সব অনুষ্ঠানের ঝুলি নিয়ে হাজির থাকত আকাশবাণী।

আজও আকাশবাণীর রং স্মৃতি নিয়ে আমাদের মনের আকাশে ছবি আঁকে। সময় আর প্রযুক্তির হাত ধরে এখন সবই আধুনিক। রেডিয়োর ভাষা থেকে তার আকৃতি সবটাই বদলেছে। তবে কিছু বন্ধন অটুট থাকে। যেমন আকাশবাণীর সঙ্গে তার ঐতিহ্য এবং বিস্তৃতির বন্ধন।

১৯২৩ সালের জুন মাসে মুম্বাইয়ের রেডিও ক্লাব প্রথমবার এই দেশে কোন অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে। এ যেন এক চমৎকার জাদুকাঠি। পৃথিবীর কোন প্রান্তে বসে একজন কথা বলছে। তরঙ্গের মাধ্যমে সেই কথা ভাসতে ভাসতে পৌঁছে যাচ্ছে অগণিত শ্রোতার কানে। আপ্লুত করছে তার মন।

এমন অদ্ভুত জাদুকাঠির কথা জেনে কলকাতাই বা পিছিয়ে থাকে কেন! এর ঠিক পাঁচ মাস পরেই কলকাতাতেও শুরু হলো 'ক্যালকাটা রেডিও ক্লাব'।

১৯২৭ সালের ২৩শে জুলাই 'ইন্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং কোম্পানি' প্রথমবার কোনো অনুষ্ঠান এবং অনেক প্রয়োজনীয় বার্তা সম্প্রচার করা শুরু করে।

এর তিন বছর পরেই ভারত সরকারের শ্রম-দপ্তর প্রথমবার পরীক্ষামূলক ভাবে শুরু করে অনুষ্ঠান সম্প্রচার। লায়োনেল ফিয়েলডেন প্রথমবার এই সম্প্রচারের নিয়ন্ত্রক হিসেবে নিযুক্ত হন। কয়েক মাস পর এই প্রথমবার আকাশবাণী মাইসোর রেডিয়ো কেন্দ্র স্থাপিত হয়। ১৯৩৬ সালের ৮ই জুন 'ইন্ডিয়ান স্টেট ব্রডকাস্টিং সার্ভিস' আত্মপ্রকাশ করে 'অল ইন্ডিয়া রেডিয়ো' হিসেবে।

১৯৬১ সালের ৮ই জুন ভারতের পোস্টাল সার্ভিস এর তরফ থেকে আকাশবাণীর জন্মদিনের ২৫বছর উপলক্ষে একটি বিশেষ ডাকটিকিট প্রকাশের মাধ্যমে সম্মান প্রদান করা হয়।

সেই থেকে শুরু এই সংস্থার যাত্রাপথ। আজও একইভাবে সে বয়ে চলেছে স্মৃতির পাহাড়। বেসরকারি রেডিয়োর গ্ল্যামারের ভিড়ে নিজের সুস্পষ্ট, আলাদা জায়গা একইভাবে ধরে রেখেছে আকাশবাণী।

আকাশবাণীর মূলমন্ত্র 'বহুজন হিতায়, বহুজন সুখায়'। সকলের মঙ্গল এবং সকলের সুখ। তথ্য ও মনোরঞ্জন দুই পরিবেশন করে আকাশবাণী।

একমাত্র সরকারি এই গণমাধ্যমই 'পাবলিক সার্ভিস ব্রডকাস্টার' বা জনসেবা সম্প্রসারক। মোট চারশো সত্তরটি কেন্দ্র রয়েছে সারা দেশ জুড়ে যেখান থেকে অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা হয়। দেশের বিরানব্বই শতাংশ স্থানে নিজেদের অনুষ্ঠান পৌঁছে দেয় আকাশবাণী।

একমাত্র অল ইন্ডিয়া রেডিয়োর তরফ থেকেই মোট তেইশটি ভাষায় এবং একশো ঊনআশি রকম আঞ্চলিক ভাষায় অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা হয়।

এভাবেই আকাশবাণী বছরের পর বছর তার সেবা ও আনন্দ প্রদানের মাধ্যমে মানুষকে নস্ট্যালজিয়ার চাদরে মুড়ে রেখেছে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...