রাধানাথের জন্ম কলকাতা শহরের জোড়াসাঁকোর শিকদার পাড়ায়। বাবা তিতুরাম শিকদার ও তাঁর পরিবার ছিল কলকাতার আদি নিবাসী ব্রাহ্মণকুলোদ্ভব। জ্যেষ্ঠপুত্র রাধানাথকে পাঠশালায় গুরুমশাইয়ের কাছে পড়ানোর পরে ফিরিঙ্গি কমল বসুর স্কুলে ভর্তি করে দেন তিতুরাম। এরপর ১৮২৪ সালে রাধানাথ হিন্দু কলেজে ভর্তি হন। সেখানে সাত বছর দশ মাস পড়াশোনা করেছিলেন তিনি। আর এই সময়েই তাঁর প্রতিভার বিচ্ছুরণ দেখা যায়। কলেজের সব শিক্ষকেরই স্নেহভাজন ছিলেন। ইংরেজির শিক্ষক ছিলেন প্রবাদপ্রতিম প্রগতিশীল ব্যক্তিত্ব হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও। তাঁর ‘ইয়ং বেঙ্গল’-এর মধ্যেও ছিলেন রাধানাথ।
স্কুলজীবন সম্পর্কে দিনলিপি লিখতেন রাধানাথ। সেই রচনায় যেমন তাঁর হিন্দু কলেজের অভিজ্ঞতার কথা জানা যায়, তেমনই ধরা পড়ে সাবেক প্রতিষ্ঠানটির ছবিও। তিনি লিখছেন, ১৮২৪ সালে তিনি কলেজের নবম (অর্থাৎ সবচেয়ে নিচু) শ্রেণিতে ভর্তি হন। তখন হিন্দু কলেজে দশটি শ্রেণি ছিল। ১৮২৬ সালে চতুর্থ শ্রেণিতে উন্নীত হন রাধানাথ, ডিরোজিওর ছাত্র হওয়ার সুযোগ পান। এর আগে তিনি মলিস সাহেবের কাছে ব্যাকরণ পড়েছিলেন, এ বার শিখলেন ইংরেজি রচনা, ব্যাকরণ, পদ্য প্রভৃতি। তবে কলেজজীবনে তাঁর কাছে সবচেয়ে জরুরি ছিলেন গণিত শিক্ষক ডক্টর টাইটলার, সংস্কৃত ভাষাতেও যাঁর অগাধ দখল ছিল।
রাধানাথ সে সময়ে হিন্দু কলেজের শ্রেষ্ঠ গণিতবিদ, তাঁর অগাধ প্রতিভা দেখে টাইটলার তাঁকে নিউটনের বিখ্যাত বই ‘প্রিন্সিপিয়া ম্যাথমেটিকা’ পড়িয়েছিলেন। ছাত্রাবস্থাতেই তিনি জ্যামিতির এমন একটি সম্পাদ্য সমাধান করে ফেলেছিলেন, যা ১৮৩১ সালে গ্লিনিংস ইন সায়েন্স পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। এই সমাধান সম্পূর্ণ ভাবে ছিল রাধানাথের নিজস্ব আবিষ্কার। ১৮৩২ সালের ১৮ ডিসেম্বর তিনি যখন হিন্দু কলেজ ছাড়লেন, সে সময় তাঁকে দেওয়া সার্টিফিকেটে লেখা ছিল, ‘ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে এবং অন্যান্য বিষয়সমূহের মূল সূত্রে তিনি বিশেষ ব্যুৎপত্তি লাভ করিয়াছেন।’ নীচে ডেভিড হেয়ার, হোরেস হেম্যান উইলসন, রামকমল সেন, রাধাকান্ত দেব, রসময় দত্তের মতো বিশিষ্টদের সই ছিল।
বিজ্ঞান পড়ার সঙ্গে রাধানাথের অন্যান্য গুণের স্ফুরণও এই হিন্দু কলেজ থেকেই ঘটেছিল। জীবনী থেকেও জানা যায়, লেখাপড়া করার সময়ও অন্নবস্ত্র জোগাড়ের জন্য তাঁকে ও তাঁর ভাই শ্রীনাথকে খুবই কষ্ট পেতে হত। সে জন্যই মাত্র আঠারো বছর বয়সে চাকরিতে যোগ দিতে হয়েছিল রাধানাথকে। রাধানাথের পরিবারের ছিল বিপুল অর্থকষ্ট। কলেজে পড়াকালীন, ১৮ বছর বয়সেই সার্ভে অফিসে চাকরিতে ঢুকলেন রাধানাথ। কলেজ পাশ করলেন পরের বছর। তিনি যোগ দিলেন ‘গ্রেট ট্রিগোনোমেট্রিক্যাল সার্ভে’-তে, পদের নাম ‘কম্পিউটার’, বেতন মাসে ৩০ টাকা। এই পদে সেই প্রথম কোনও ভারতীয় সুযোগ পেয়েছিলেন। রাধানাথের বিস্ময়কর প্রতিভা, পড়াশোনার গভীরতা, গবেষণার ব্যাপ্তি, উদ্ভাবনী শক্তির কারণে টাইটলারের প্রিয় পাত্র হয়ে উঠেছিলেন তিনি। টাইটলারই প্রখ্যাত বিজ্ঞানী জর্জ এভারেস্টের কাছে তাঁর নাম প্রস্তাব করেন।
এভারেস্ট ছিলেন ‘সার্ভেয়র জেনারেল অব ইন্ডিয়ার সুপারিনটেনডেন্ট। রাধানাথের কাজে তিনি ছিলেন মুগ্ধ। রাধানাথের উপর এতটাই নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলেন তিনি যে, তাঁকে নিজের ডান হাত বলতেন। ১৮৩৭ সালে এক বার হিন্দু কলেজের বেশ কিছু প্রথম সারির কৃতী ছাত্র ডেপুটি কালেক্টরের পদে চাকরির জন্য দরখাস্ত করেন। প্রার্থী ছিলেন রাধানাথও। সে কথা জানতে পেরেই প্রমাদ গনেন এভারেস্ট। তিনি বুঝেছিলেন, রাধানাথ চলে গেলে ট্রিগোনোমেট্রিক্যাল সার্ভের অসুবিধে তো হবেই, তবে এক ভারতীয় প্রতিভারও অপমৃত্যু ঘটবে। তিনি সরকারকে এমন ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করেন, যাতে এই সব ক্ষেত্রে বিভাগীয় প্রধানের অনুমতি ছাড়া কোনও দেশীয় কর্মচারী বিভাগ পাল্টাতে না পারেন। এই সূত্রে ‘কোর্ট অব ডিরেক্টর্স’-এর অনুমতি নিয়ে কর্তৃপক্ষ সার্কুলার জারি করেন। রাধানাথ রয়ে যান সার্ভেতেই। বাকিটা ইতিহাস।
অবশ্য এর পরেও সার্কুলার অগ্রাহ্য করে রাধানাথ ভিন্ন চাকরির জন্য আবেদনপত্র পাঠিয়েছিলেন। সেটা ১৮৫০ সাল, কলকাতার ম্যাজিস্ট্রেট পদ খালি হয়েছিল। রাধানাথ সম্ভবত কিছুটা বেশি বেতনের আশাতেই সেই পদের জন্য আবেদন করেছিলেন। ততদিনে এভারেস্ট অবসর গ্রহণ করেছেন, সার্ভেয়র জেনারেলের পদে এসেছেন অ্যান্ড্রু ওয়া। তিনিও বলতেন, রাধানাথের মতো প্রতিভাধর, পরিশ্রমী গণিতবিদ ও জরিপবিদ পাওয়া দুষ্কর, তিনি বিভাগের সম্পদ। সরকারের কাছে তাঁর বেতন বৃদ্ধির সুপারিশ করলেন ওয়া। সঙ্গে এভারেস্টের মতোই লিখলেন একটি প্রশস্তি চিঠি। সে যাত্রাতেও চাকরি পাল্টানো হল না রাধানাথের। ১৮৫০ সালের ২০ অক্টোবর ট্রিগোনোমেট্রিক্যাল সার্ভে সম্পর্কে ইংল্যান্ডের ‘হাউস অব কমন্স’-এ একটি দীর্ঘ রিপোর্ট জমা দিতে হয়েছিল ওয়াকে। সহকর্মীদের ভূয়সী প্রশংসা করতে গিয়ে রাধানাথের কথা আলাদা করে উল্লেখ করেছিলেন তিনি।
আসলে, ভারতে ত্রিকোণমিতির সাহায্যে জরিপের কাজ করার জন্য নিজস্ব যে সব অভিক্ষেপ পদ্ধতির ফর্মুলা আবিষ্কার করেছিলেন এভারেস্ট, সেগুলিরই কিছু কিছু পরিমার্জন করেছিলেন রাধানাথ। তাই তিনি ছিলেন অপরিহার্য। এভারেস্ট উদ্ভাবিত ‘রে ট্রেস মেথড’-ও পরিবর্ধন ও পরিমার্জন করেছিলেন রাধানাথ।
সালটা ১৮৫২। পর্যবেক্ষণের কাজ চলছে। রাধানাথ তখন ৬০০ টাকা বেতনে প্রধান কম্পিউটার পদে অধিষ্ঠিত। শোনা যায়, হঠাৎ একদিন ছুটতে ছুটতে এসে ওয়া সাহেবকে তিনি বলেন, “স্যর, আমি পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু শৃঙ্গটি আবিষ্কার করে ফেলেছি।” সরকারিভাবে সেই ঘোষণা হতে আরও বছর চারেক সময় লেগেছিল। বারবার হিসেবের পর ১৮৫৬ সালে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, ১৫ নম্বর শৃঙ্গটিই বিশ্বের সর্বোচ্চ। নাম দেওয়া হয় ‘মাউন্ট এভারেস্ট’। বর্তমানে নেপালে অবস্থিত এই শৃঙ্গটির অবশ্য তখনই স্থানীয় একটি তিব্বতি নাম ছিল, ‘চোমোলুংমা’, অর্থাৎ ‘পৃথিবীর মা’।
১০০ মাইলের মতো দূর থেকে এই শৃঙ্গের উচ্চতার বেশ কয়েকটি পরিমাপ নিয়ে যখন গড় করা হয়, তখন হিসেব আসে ঠিক ২৯,০০০ ফুট। কিন্তু এমন ‘রাউন্ড ফিগার’ সার্ভেয়ারদের ধন্দ জাগায়। তাঁরা এও ভাবেন যে, নিটোল সংখ্যা দেখে জনসাধারণের মনে শৃঙ্গের উচ্চতা সম্পর্কে অবিশ্বাস দানা বাধতে পারে। সে জন্য অতিরিক্ত ২ ফুট যোগ করে শৃঙ্গের উচ্চতা দাঁড়ায় ২৯,০০২ ফুট; ১৯৫৪ পর্যন্ত যা ছিল সরকারি হিসেব। পরে অবশ্য এভারেস্টের উচ্চতা বেড়ে দাঁড়ায় ২৯,০২৮ ফুট।
কিন্তু বহু দিন যাবৎ এই আবিষ্কারের স্বীকৃতি পাননি রাধানাথ। ১৮৮৪ সালে আর্যদর্শন পত্রিকায় যখন রাধানাথের দিনপঞ্জি ও অন্যান্য তথ্য সাজাচ্ছেন তাঁর জীবনীকার যোগেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, তখন উচ্চতম শিখরটির নাম ও উচ্চতা জ্ঞাত হলেও গণনাকারীর নাম ফাইলবন্দি, অর্থাৎ জনসমক্ষে অপ্রকাশিত। জীবনীকার লিখছেন, “যৌবনের প্রারম্ভে গৃহত্যাগী হইয়া সত্যের অনুসন্ধানে কর্নেল এভারেস্টের সহিত হিমালয় শিখরে শিখরে পর্যটন করিয়াছিলেন।” আর পাদটীকায় জানাচ্ছেন, “উক্ত মহাত্মার নামেই হিমালয়ের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ ‘এভারেস্ট শৃঙ্গ’ নামে অভিহিত হইয়া থাকে। ইনিই রাধানাথের পরম বন্ধু ও শিক্ষক ছিলেন।” রাধানাথের পরবর্তী জীবনীকার শিবনাথ শাস্ত্রী ১৯০৩ সালে রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গ সমাজ বইয়ে ‘নব্যবঙ্গ’-এর নায়ক তথা রামতনুর সুহৃদবর্গের অন্যতম রাধানাথ প্রসঙ্গে অনেক কথা লিখলেও সেখানে শৃঙ্গের কোনও উল্লেখ মেলে না। রাধানাথ প্রধান কম্পিউটারের পদে পৌঁছেছিলেন; সার্ভে সংক্রান্ত গণিতে এতটাই পারদর্শী ছিলেন যে, কর্নেল থুলিয়ার সার্ভে বিষয়ে যে বিখ্যাত বই প্রকাশ করেন, তার প্রধান গণনাগুলি রাধানাথই লিখে দিয়েছিলেন।
একটা দীর্ঘ সময় এভারেস্টের উচ্চতা মাপকের স্বীকৃতি পাননি রাধানাথ। আবার সেই তথ্য জনসমক্ষে আসার পর থেকে আজ পর্যন্ত তাঁর অবশিষ্ট পরিচয়গুলো চাপাই পড়ে গেল। জরিপবিদ রাধানাথ ভারতের আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চারও পথিকৃৎ। ইন্ডিয়া মেটেরোলজিক্যাল ডিপার্টমেন্ট, কলকাতার প্রাক্তন ডিরেক্টর অজানা চৌধুরীর লেখা থেকে জানা যায়, ১৮৫৩ সালে কলকাতার আকাশে নক্ষত্রদের সংক্রমণ পর্যবেক্ষণের উপর ভিত্তি করে জাহাজ চলাচল যাতে সুষ্ঠু ভাবে হতে পারে, সে জন্য সময়-সিগন্যালের ব্যবস্থাও করেছিলেন রাধানাথ।
তিনিই জানান, ভারতে আবহাওয়া বিজ্ঞানেরও প্রধান পথপ্রদর্শক ছিলেন রাধানাথই। বহু পণ্ডিত মানুষ গবেষণার কাজে সহায়তা পেতে রাধানাথের দ্বারস্থ হতেন, সব সময়ই নিঃস্বার্থ ভাবে সাহায্য করতেন তিনি। যখনই কেউ তাঁর সাহায্য চেয়েছেন, তিনি যথাসাধ্য হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। ১৮৬২ সালের মার্চ মাসে চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পরে পুরোপুরি নিজেকে উন্নয়নমূলক সামাজিক কাজে ব্যস্ত রেখেছিলেন। ১৮৭০ সালের ১৭ মে আজকের দিনে এই গবেষক আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন।