এক ছক-ভাঙা মেয়ের গল্প: ভাবনা জাট

ঘড়িতে সময় সকাল তিনটে। মধ্যরাতও বলা যেতে পারে। মেয়ে যাবে অনুশীলন করতে। হাঁটতে হবে তাকে। ঘড়ি ধরে নিয়ম মেনে। 'রেস ওয়াকিং'। মেয়েটির বাবা একটু পরেই চাষের কাজে বেরোবেন। মেয়ে ততক্ষনে 'প্র্যাকটিস' শেষ করে ঘরে ফিরে আসবে।

নইলে মেয়েকে 'অন্যরকম' পোশাক পরানোর জন্য কথা শুনতে হবে বাবাকে। অথচ রেস ওয়াকিং অনুশীলন করতে এমন পোশাকেরই প্রয়োজন। তবে মেয়ের জেদের কাছে হার মেনেছিল সামাজিক বেড়াজাল। রাজস্থানের ভাবনা জাট এমনই ছকভাঙা কন্যা। এবছরের টোকিও অলিম্পিকে কুড়ি কিলোমিটার রেস-ওয়াকিং বিভাগের প্রতিযোগী সে।

ভাবনার জন্ম ১৯৯৩ সালের ৩রা জানুয়ারি। রাজস্থানের প্রত্যন্ত গ্রাম কাবরা। সেখানেই বড় হয়ে ওঠা এই অ্যাথলিটের। দারিদ্র্য তাঁদের নিত্যসঙ্গী। ভাবনার বাবা চাষাবাদ করে ভরণ-পোষণ করেন সংসারের।

তবে ভাবনার স্বপ্নেরা কোন গন্ডি মানেনি। ছোট থেকেই খেলার প্রতি উৎসাহ ছিল তার।

সে বেছে নেয় রেস-ওয়াকিং। প্রথমদিকে নিজেই নিজেকে প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করে সে। শুরুতেই বাধা।

দিনের আলোয় প্রকাশ্যে একা একটি মেয়ে হেঁটে চলেছে। গ্রামবাসীর চোখে তার পোশাক 'অশালীন'। মেয়ের পোশাক নিয়ে বাবাকে অভিযোগ জানাল গ্রামবাসীরা। কিন্তু বাবা জানত এ মেয়ের চোখে দিগন্তের স্বপ্ন। সে ছুঁতে চায় সাফল্যের পাহাড়।মেয়েকে তেমনভাবেই বড় করা হয়েছিল। ভাবনার দাদাও যথেষ্ট উৎসাহ দিয়েছে তাকে।

Bhawna

তবে ভাবনার জীবনে স্বপ্ন ছোঁয়ার পথে ছিল বাধাও। শুধু সামাজিক বেড়াজালের বাধাই ছিলনা, সঙ্গী ছিল আর্থিক বাধাও। রেস ওয়াকিং অনুশীলন করার জন্য ছিল না প্রয়োজনীয় জুতো। এমনকি প্রশিক্ষণের কিটও ছিল না। অনেকেই ভেবেছিল এই স্বপ্ন ডানা মেলার আগেই শেষ হয়ে যাবে।

ভাবনার গ্রামবাসীরা ভেবেছিল হয়তো রাজস্থানের রুক্ষ-শুষ্ক প্রান্তরে এমন কাঠিন্য ভরা ইচ্ছেরা বাঁচার সুযোগই পাবে না। কিন্তু সেই অলক্ষ্যকেই লক্ষ্য হিসেবে নিয়েছিল ভাবনা জাট। অভাবের জন্য পড়াশোনা ছেড়ে দিতে হয়েছিল। তবে নিজের অর্জিত শিক্ষা আর মেধার জোরে চাকরি পেয়েছিল পূর্ব রেলে। কিন্তু হাওড়া রেলওয়ের টিকিট পরিদর্শক ভাবনা জাট সরে আসেনি তার মূল লক্ষ্য থেকে।

তার প্রতিদিনের কঠিন অনুশীলন তাকে পৌঁছে দিল এক উচ্চতায়। অলিম্পিক।

তবে প্রথমবার কোন ভারতীয় হিসেবে ভাবনা জাট নজরে আসে ২০১৯ সালের 'ন্যাশনাল ওপেন চ্যাম্পিয়নশিপ'-এর রেস ওয়াকিং প্রতিযোগিতায়।

কুড়ি কিলোমিটার পথ সে প্রথম বার বার পার করেছিল এক ঘন্টা আটত্রিশ মিনিট ত্রিশ সেকেন্ডে।

সকলের নজরে আসে এই লড়াকু স্বপ্ন-কন্যা।

তারপর একের পর এক সাফল্য। 'অল ইন্ডিয়া ইন্টার রেলওয়ে অ্যাথলেটিক্স চ্যাম্পিয়নশিপ' প্রতিযোগিতায় ভালো ফল করেছিল ভাবনা। এ বছরের টোকিও অলিম্পিকে বিশেষ রেকর্ড গড়েছে ভাবনা। এ বছর অলিম্পিকে সুযোগ পাওয়ার জন্য কুড়ি কিলোমিটার রেস বিভাগে নির্ধারিত সময় ছিল এক ঘন্টা একত্রিশ মিনিট। ভাবনা তার কুড়ি কিলোমিটার রেস শেষ করেছে এক ঘন্টা ঊনত্রিশ মিনিট চুয়ান্ন সেকেন্ডে। অভিনব সাফল্য।

অ্যাথলিট হিসেবে ভাবনা প্রথম তার কেরিয়ার শুরু করে ২০১৬ সালে। হায়দ্রাবাদে ইন্টার-স্টেট চ্যাম্পিয়নশিপ প্রতিযোগিতায় পঞ্চম স্থান অধিকার করেছিল ভাবনা। তারপর ইচ্ছে-ডানায় রঙিন পালক যোগ করেছে ভাবনার জেদ আর পরিশ্রম।

এই জেদি, লড়াকু মেয়ে কখনো ‘অ্যাথলেটিকস ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়া’র কোনো ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নেওয়ার সুযোগ পায়নি। বর্তমানে সে তার ব্যক্তিগত কোচ গুরমুখ সিহাগের কাছে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে।

এমনিতেই এই বছরের অলিম্পিক 'জেন্ডার-ব্যালেন্সড'। মহিলা ও পুরুষ প্রতিযোগীর সংখ্যা প্রায় সমান সমান। এই প্রথমবার। ভাবনার কথায় এবছরের অলিম্পিক তার কাছে 'স্বপ্নের সত্যি হয়ে ওঠা'। নিজের গ্রামে সে কোনোদিন তার প্রাপ্য সম্মান পায়নি। গ্রামবাসীদের ভালোবাসা আর সম্মানের অপেক্ষায় আছে ভাবনা। ক্রীড়াজগতের এই নতুন তারা আরও অনেক এমন দিগন্ত ছোঁয়ার অপেক্ষায় রয়েছে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...