রবীন্দ্রনাথ, পঙ্কজ কুমার মল্লিক ও একটি গান

রবীন্দ্রনাথের অধিকাংশ কবিতা, স্বয়ং তাঁর সুরেই গান হয়েছে। কিন্তু একটি কবিতা, তাঁর সুর না পাওয়া সত্ত্বেও গান হয়ে গিয়েছিল। সে গানের নেপথ্যে রয়েছে এক উত্তেজক গপ্পো।

১৯০৭ সাল রবি ঠাকুর লিখলেন, 'দিনের শেষে ঘুমের দেশে'। কবির খেয়া কাব্য গ্রন্থের একটি কবিতার অংশ এটি। এই কবিতায় সুর দিয়ে,গান বানিয়ে নানান জলসা গেয়ে বেড়াতেন পঙ্কজ কুমার মল্লিক। এ খবর পৌঁছয় জোড়াসাঁকোতে। রথীন্দ্রনাথ ডেকে পাঠান পঙ্কজ মল্লিককে, গানটি শুনতে চান পঙ্কজ বাবুর গলায়। তিরস্কৃত হওয়ার ভয়ে পঙ্কজ মল্লিক বলেছিলেন, গানটির রবীন্দ্রনাথেরই সুর করা। কবিপুত্র সে কথা বিশ্বাসও করেছিলেন।এর মাসখানেকের মধ্যেই ফের তাঁর ডাক পড়ে ঠাকুর বাড়িতে। এবার তাঁকে গানটি গেয়ে শোনাতে হয় রবি ঠাকুরকে!

পঙ্কজ বাবুর লেখা, আমার যুগ আমার গান-এ তিনি ঐ দিনের স্মৃতিচারনা করেছেন। তাঁর লেখা অনুযায়ী, রথীন্দ্রনাথের নির্দেশে তিনি অর্গানে বসে গান গাইতে শুরু করেছিলেন। কবি তখন চোখ বুজে ছিলেন। ওদিকে ঘেমে নেয়ে উঠেছিলেন পঙ্কজ মল্লিক। আড় চোখে কবিকে দেখছিলেন। কবি যে গান শুনছিলেন তা বেশ বুঝতে পেরেছিলেন পঙ্কজ বাবু। এক তরুণের যা হয় তাঁরও তাই হয়েছিল। কারণ উল্টো দিকের মানুষটির নাম রবীন্দ্রনাথ। তাঁর সামনে তাঁর কথা নিজের সুরে গাওয়া, একি সহজ কথা!

গান শেষে উঠে দাঁড়ানোর মতো মনোবল ছিল না পঙ্কজ মল্লিকের। গান কেমন লাগল, একথা জিজ্ঞাসা করার সাহস সঞ্চয় করে উঠতে পারেননি। কোন ক্রমে অর্গান ছেড়ে উঠে, পাশের দরজা দিয়ে সোজা নীচে নেমে দ্বারকানাথ ঠাকুরের গলি ধরে চিৎপুর পেরিয়ে নিজের বাড়ি চলে গেলেন পঙ্কজ মল্লিক।

এরপর ১৯৩৫ সাল নিউ থিয়েটারসের ব্যানারে ছবি বানাচ্ছেন প্রমথেশ বড়ুয়া। ছবির নাম মুক্তি। সেই ছবির জন্য রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে এই গানটির পাকাপাকি অনুমোদন লাভ করেন পঙ্কজ বাবু। গানটি ছবিতে ব্যবহৃত হয় এবং গ্রামাফোনের ডিস্কেও প্রকাশ পায়। অরাবীন্দ্রিক কাহিনীচিত্র প্রথমবারের জন্য রবীন্দ্র সঙ্গীত ব্যবহৃত হয়।

তবে এই অনুমোদন আদায়ের ঘটনাটিও বেশ মজার। রবীন্দ্রনাথ তখন প্রশান্তচন্দ্র মহালনবীশের বরাহনগরের বাড়িতে। হাজির হলেন পঙ্কজ মল্লিক, বললেন কয়েকটি গান ছবিতে ব্যবহার করতে চাই। সঙ্গে দিনের শেষে নিজে গাইবেন বলেও অনুমতি চাইলেন। দিনের শেষে গানটির কথা শুনেই হেসে ফেললেন রবীন্দ্রনাথ। বলেছিলেন, 'এ গান তো আমায় শুনিয়েই তুমি পালিয়ে গিয়েছিলে, অমন সুন্দর গলা তোমার পালালে কেন?'

এরপর কি আর উত্তর থাকে...

আবার সেই গান শুনতে চাইলেন কবি, পঙ্কজ এবারও শুনিয়েছিলেন। কবি খুবই প্রীত হয়ে সম্মতি দিয়েছিলেন। কিছুক্ষণ পরে কবি গানের কথা একটু বদল করে দিলেন, 'ফুলের বার নাইকো যাব ফসল যার ফললো না / চোখের জল ফেলতে হাসি পায়' - এর বদলে বললেন, 'ফুলের বাহার নাইকো যাহার ফসল যাহার ফললো না / অশ্রু যাহার ফেলতে হাসি পায়'।

পঙ্কজ বাবুকে বললেন তুমি লিখে নাও, তিনি তাই করলেন। তৈরি হল ইতিহাস। শোনা যায় মুক্তি নামটিও ছবি চিত্রনাট্য শুনে রবীন্দ্রনাথই ঠিক করেদিয়েছিলেন। ১৯৩৭-এ মুক্তি মুক্তি পায়। ওই ছায়াছবিতে পঙ্কজ মল্লিক চারটি রবীন্দ্রসংগীত ব্যবহার করলেন — 'দিনের শেষে', 'আমি কান পেতে রই', 'সবার রঙে রঙ মেশাতে হবে' ও 'তার বিদায় বেলার মালাখানি'। যার মধ্যে দিনের শেষে- গানটিতে তিনি নিজেই ১৯২২-এ সুরারোপ করেছিলেন। ছবিতে প্রথম দুটি গান নিজে ও পরের দুটি ছবির নায়িকা কাননদেবী গেয়েছিলেন।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...