রবীন্দ্রনাথের গান বাঙালির নিজস্ব সম্পদ। কিন্তু আজ যারা এই গানের শ্রোতা তাদের অনেকের কাছেই সাহানা দেবী কিছুটা অচেনা, অজানা। একদিন তাঁর গানের সুর মুগ্ধ করেছিল স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকে। তিনি বলেছিলেন, “যদি আমার ঘরের পাশে তুমি কোনোদিন বাসা বেঁধে থাকো তাহলে আমার পথহারা গানগুলিও দিনের পর দিন তোমার মধ্যে আশ্রয় পেতে থাকবে”।
১৮৯৭ সালের জ্যৈষ্ঠ মাসে সাহানা দেবীর জন্ম। তাঁর বাবা ডাক্তার প্যারীমোহন গুপ্ত ছিলেন ফরিদপুরের সিভিল সার্জেন। সাহানার মা তরলা দেবী ছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের দিদি। সাহানা দেবীর যখন মাত্র কয়েক দিন বয়েস তখন এক ভয়ঙ্কর ভূমিকম্পে তাঁর মা তাঁকে কোলে নিয়ে খোলা আকাশের নীচে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। প্রবাদ আছে, সকাল দিনের সূচনা করে। সাহানার জীবনে যে ঘরের বদ্ধ জীবনাচরণের বদলে সত্য হয়ে উঠবে আকাশতলের উন্মুক্ততা সেই ইঙ্গিতই কি ছিল সেদিনের সেই ভূমিকম্পে?
ফরিদপুরের যে বাড়িতে সাহানার জন্ম সেই বাড়িতে তাঁর দিদি ও বাবার মৃত্যু হয়। তাঁর বাবার মৃত্যুর সময় সাহানা ছিলেন নিতান্তই শিশু। এরপর তাঁর মা তাঁদের নিয়ে কলকাতায় বাবা ও ভাইয়ের আশ্রয়ে চলে আসেন। মামাবাড়ির এক সুমধুর জীবনছবি সাহানা দেবী তাঁর স্মৃতিকথায় ধরে রেখেছেন। অসম্ভব তাড়াতাড়ি কোথাও না থেমে একনিশ্বাসে কথা বলতেন সাহানা তাই তাঁর দাদু ভুবনমোহন দাশ তাঁকে ডাকতেন 'বম্বে মেল’ বলে। আরও একটি আদরের নাম ছিল তাঁর সেও তাঁর 'দাদাবাবুর’ দেওয়া - ঝুনু বাঈ। “বোধহয় গান করতে পারতাম বলে”।
“সাত-আট বছর বয়েসেই গ্রামোফোন রেকর্ড থেকে লালচাঁদ বড়ালের সব গান গলায় তুলে তার ঢং ঢাং সব হুবহু অনুকরণ করে গাইতে পারতাম”। সেই কারণে চিত্তরঞ্জন দাশ তাঁকে বলতেন, “Imitation of Baral বলে তুই গ্রামোফোনে গান দে”। এর আগে পুরুলিয়ায় তাঁর মাসিমা বিখ্যাত গায়িকা অমলা দাশ যখন অন্যান্যদের গান শেখাতে বসে খাম্বাজে টপ্পা ঢঙের “আয়ে আজু মেরা আয়ে নন্দলালা” গাইছিলেন তখন শিশু সাহানা গানটি শুনে সবার আগে নির্ভুল সুরে গলায় তুলেছিলেন। এই গানটি বালিকা সাহানা নানা জায়গাতে নানা জনকেই শুনিয়েছিলেন। শুনেছিলেন ইন্দিরা দেবী চৌধুরানীও। এতটাই ভালো লেগেছিল তাঁর যে পরবর্তী সময়ে বারবার তা শুনতে চেয়েছিলেন। মৃত্যুর কিছুদিন আগে শান্তিনিকেতন থেকে লেখা শেষ চিঠিতেও তিনি লিখেছিলেন, “সেই, কতকাল আগে একটা ঝাঁকড়া চুলওয়ালা পাগলী(!) মেয়েকে জানতাম, যে মাথা ঝাঁকুনি দিয়ে 'আয়ে নন্দলালা’ গাইত- মনে আছে? তারপর বড়ঝুনু নামে কতবড় গাইয়ে হল। তখন থেকে একেবারে ডুব মারল”।
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে রাখীবন্ধন ও অরন্ধনে বাংলাদেশ উত্তাল হয়ে উঠেছিল। স্বদেশী সঙ্গীত তখন সকলের মুখে মুখে। বালিকা সাহানারাও গাইতেন 'বন্দেমাতরম্’, 'বিধির বাঁধন কাটবে তুমি’, ‘ওদের বাঁধন যতই শক্ত হবে’, ইত্যাদি গান। এই সময়ের কাছাকাছি "একদিন আমাকে কোলে করে নিয়ে এক বিরাট সভার মাঝখানে একটি টেবিলের ওপর দাঁড় করিয়ে দেওয়া হল। আমি গাইলাম - আমরা নেহাত গরীব, আমরা নেহাত ছোট/ তবু আছি সাতকোটি ভাই জেগে ওঠো”।
সাহানা দেবীর মাসিমা অমলা দাশ রবীন্দ্রপরিবারের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তিনিই সাহানা দেবীকে প্রথম রবীন্দ্রনাথের কাছে নিয়ে গিয়ে বলেছিলেন, “রবিকাকা, আমাদের এই মেয়েটির গান শুনবে?” বালিকা সাহানা অমলা দাশের কাছে শেখা একটি গান রবীন্দ্রনাথকে শুনিয়েছিলেন। এরপর থেকে রবীন্দ্রনাথ যখনই তাঁদের রসা রোডের বাড়িতে আসতেন সাহানার খোঁজ করতেন। ছোট বয়সে সাহানা দেবী গান গাইতে এত ভালোবাসতেন যে বাড়িতে কেউ এলে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতেন যে কখন তারা গান গাইতে বলবেন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গেও এমনটি করেছেন বালিকা সাহানা-‘উনি আসবেন আগে থেকে জানতে পারলে নিজেই গিয়ে হাজির হতাম ওঁর কাছে আর নীরব আগ্রহে তাকিয়ে থাকতাম একবার ওঁর গাইতে বলার অপেক্ষায়”। রবীন্দ্রনাথ বালিকার এই আগ্রহ খুশীমনে উপভোগ করতেন।
সাহানা দেবীর যখন বারো বছর বয়েস তখন রবীন্দ্রনাথ তাঁকে গান শেখাবার জন্য বিষ্ণুপুরের সুবিখ্যাত গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাই সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে পাঠিয়েছিলেন। ‘কবির পাঠানো এই সুরেনবাবুর কাছেই আমার প্রথম গান শিক্ষা আরম্ভ’। এর কাছেই সাহানা দেবী স্বরলিপি করতে এবং স্বরলিপি দেখে গাইতে লিখেছিলেন। পনেরো বছর বয়েসে জোড়াসাঁকোর মাঘোৎসবে সাহানা গান গেয়েছিলেন। “আমি গান করেছিলাম মেয়েরা যেদিকে বসেছিলেন তাদের মাঝখানে। উঠোনে নামবার সিঁড়িতে জায়গা করা হয়েছিল। সেইখানে বিবিমাসিমা (ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী) টেবিল হারমোনিয়াম বাজিয়েছিলেন আর আমি তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে দুটো গান করি-‘যদি প্রেম দিলে না প্রাণে' আর ‘লুকিয়ে আস আঁধার রাতে'। এই গানটির স্মৃতি ধরা আছে শৈলজারঞ্জন মজুমদারের লেখাতেও।
১৯১১ সালে সাহানা দেবী প্রথমবার শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলেন। সেখানে 'রাজা’ অভিনয় দেখে মন্ত্রমুগ্ধ সাহানা অনেক পরে লিখেছিলেন, “সে যে কী ভালোই লেগেছিল, এমন নতুন ধরণের আর এমন অদ্ভুত মনে হয়েছিল”।
রবীন্দ্রনাথ কলকাতায় এলেই ডাক পড়ত সাহানার। যেবার দিনেন্দ্রনাথ আসতেন সেবার দিনেন্দ্রনাথের কাছেই শিখতেন নতুন সব গান। না হলে কবি নিজেই শেখাতেন। এমনই একবার দিনেন্দ্রনাথ এসেই ডাক পাঠিয়েছেন, 'ঝুনু, চলে এস। অনেক নতুন গান আছে’। সাহানা দেবী তো ছটফট করছেন যাবার জন্য। কিন্তু গাড়ি পাওয়া গেল না। তখন নিরূপায় সাহানা তাঁর মামা চিত্তরঞ্জন দাশের অফিস ঘরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে টেলিফোনে চোদ্দটা গান শিখেছিলেন। “দিনুদা জোড়াসাঁকো থেকে টেলিফোনে গাইছেন আর আমি ভবানীপুর রসা রোডে টেলিফোন ধরে গান শিখছি- সে ভারি মজা”। রবীন্দ্রনাথ এই সঙ্গীতশিক্ষার কথা শুনে বিস্মিত হয়েছিলেন। বলেছিলেন, “এমন গান পাগলা আমি আর কোনো মেয়েকে দেখলুম না”। সাহানা দেবীকেও একবার বলেছিলেন কবি, “তোমাকেই দেখলুম যে সংসারের থেকেও গান তোমার কাছে এত প্রিয়। মেয়েদের মধ্যে এটা কমই দেখা যায়। তারা সংসার করতে বড্ড ভালোবাসে”। কত গান যে সাহানা শিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথের কাছে - ‘অলকে কুসুম না দিয়ো’, ‘না না গো না’, ‘জয়যাত্রায় যাও গো’, ‘না বলে যায় পাছে সে’, ‘গান আমার যায় ভেসে যায়’, ইত্যাদি।
১৯১৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি রসা রোডের বাড়িতে ড. বিজয় বসুর সঙ্গে সাহানা দেবীর বিবাহ হয়। বিয়ের পর তিনি চলে যান কাশীতে- তাঁর স্বামীর কর্মক্ষেত্রে। সেখানে সম্ভ্রান্ত বংশের মহিলারা পারিবারিক নানা অনুষ্ঠানে বিশেষত বিয়ে ইত্যাদিতে নিজেদের মধ্যে নাচগান করতেন। সাহানা দেবীর ছোট থেকেই নাচ শেখার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু “আমাদের সমাজে তখন এসব ইচ্ছে আমল পেত না, কাজেই মনের ইচ্ছে প্রকাশ করিনি”। কাশীতে সে সুযোগ এল। এক প্রবাসী বাঙালি বান্ধবীর কাছে নিভৃতে নাচ শিখলেন সাহানা। ঘুঙুরের সামান্য আওয়াজ হলেই তাঁর স্বামী আপত্তি করতেন - “তাঁর প্র্যাকটিসের ক্ষতি হবার আশঙ্কায়”। কলকাতায় মামার বাড়িতে আসার পর চিত্তরঞ্জন দাশ ও বাসন্তী দেবী সহ পরিবারের অনেকেই দেখলেন। খুশিও হলেন। দেশবন্ধু তাঁর দুই মেয়েকেও নাচ শেখাতে বললেন। সাহানা দেবী অতুলপ্রসাদের ‘বঁধূ ধর ধর মালা পড় গলে’ গানের সঙ্গে নিজে নাচ কম্পোজ করে নেচেছিলেন। সেকালে তা বড় সহজ ছিল না। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে কোনও এক কন্যার বিবাহ উপলক্ষে মেয়েরা নিজেরা আনন্দ করার জন্য যে নাচগানের আসর বসিয়েছিল সেখানে পুরুষদের প্রবেশাধিকার ছিল না। সেখানেই লুকিয়ে তাঁর নাচ দেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ এবং সৌমেন্দ্রনাথও। বিবাহিত জীবন সুখের হয়নি সাহানা দেবীর। মনের মিল না হওয়ায় তিনি গৃহত্যাগ করেছিলেন।
১৯২২ সাল পর্যন্ত সাহানা দেবী ছিলেন কাশীতে। সেই সময় রবীন্দ্রনাথ একবার সেখানে এসেছিলেন। কাশীর মহারাজার অতিথি হয়ে তাঁর প্রাসাদে ছিলেন। সংবাদ পেয়ে দেখা করতে গিয়েছিলেন সাহানা দেবী। রবীন্দ্রনাথ প্রশ্ন করেছিলেন, “তারপর, গানটান কর আজকাল? না সব ছেড়ে দিয়ে বসে আছ”? উত্তরে সাহানা দেবী বলেছিলেন, গানের তৃষা তাঁর কোনোকালেই যাবার নয়। কবি খুশী হয়ে বলেছিলেন, ”যাক শুনে খুশী হলুম যে তোমার গান শেখার মন আছে। এক তোমাকেই দেখলুম বিয়ে করেও গান ছাড়নি। তোমাদের মেয়েদের হয় বিয়ে নয় গান, দুটোর মাঝামাঝি কিছু নেই”। আহ্বান জানিয়েছিলেন,” এক কাজ করো ঝুনু, তুমি চলে এসো আমাদের শান্তিনিকেতনে তোমার স্বামীকে নিয়ে। তিনি সেখানে ডাক্তারি করবেন আর তুমি আমাদের তোমার গানে ভরে দেবে”। তা সম্ভব ছিল না সাহানা দেবীর। তবে এরপর যখন মানসিক ও শারীরিকভাবে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়ে পড়েন সাহানা- কার্যত আশ্রয়হীনা, ক্ষয়রোগাক্রান্ত। তখন রবীন্দ্রনাথ তাঁকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। কাশীতেও কবির কাছে একাধিক গান শিখেছিলেন সাহানা। ‘জীবনমরণের সীমানা ছাড়ায়ে’, ‘গানের ভিতর দিয়ে যখন’, ‘দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায়', 'আমি তারেই খুঁজে বেড়াই’, 'সুর ভুলে যেই ঘুরে বেড়াই’ ইত্যাদি এগারোটি গান। মাত্র দুদিনে শেখা গানগুলি ঠিকমতো তোলা হল কিনা সে পরীক্ষা নিয়েছিলেন স্বয়ং কবি। দিয়েছিলেন 'Full marks’। বলেছিলেন, “ঝুনু তোমায় গান শিখিয়ে বাস্তবিক আনন্দ আছে। আহা, তোমায় যদি সেরকম কাছে পেতুম কত গান যে শেখাতুম মনের সাধে”।
১৯২৩ সালে কলকাতায় চলে আসার পর 'বসন্ত উৎসবে' সাহানা দেবী গেয়েছিলেন,'ও আমার চাঁদের আলো', ‘যদি তারে নাই চিনি গো’, ‘শুকনো পাতা কে ছড়ায়’, 'খেলার সাথী বিদায় দ্বার খোলো’ আর ' যাওয়া আসারই একি খেলা’। রবীন্দ্রনাথ সাহানা দেবীর গলায় নানা কাজের হিন্দী গান শুনতে খুব ভালোবাসতেন। তাঁর গাওয়া অনেক হিন্দী গানে নতুন করে কথা বসিয়ে নতুন গানও তৈরি করেছিলেন কবি। ‘খেলার সাথী বিদায় দ্বার খোল’, 'যাওয়া আসারই এ কি খেলা’- এমনই দুটি গান। আরও একটি হিন্দী গান ভেঙে রবীন্দ্রনাথ তৈরি করেছিলেন 'বুঝি ওই সুদূরে ডাকিল মোরে’। এই গানটি সাহানা দেবী ছাড়া আর কারোরই জানা ছিল না। অনেক পরে তিনি যখন পন্ডিচেরিবাসী তখন গানটি টেপরেকর্ডে ধরে রেখেছিলেন যাতে গানটি হারিয়ে না যায়।
১৯২৬ সালে সাহানা দেবী গুরুতর অসুস্থ হয়ে রবীন্দ্রনাথের আশ্রয়প্রার্থী হন। এর আগেও জীবনের এক সঙ্কটের সময় তিনি রবীন্দ্রনাথের কাছে পরামর্শ চাইলে কবি দ্বিধাহীন ভাষায় একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, “যদি কোনোদিন তোমার তেমন প্রয়োজনই ঘটে তাহলে আমার কাছে আসতে লেশমাত্র সঙ্কোচ বোধ কোরো না”। সেবার অসুস্থ হয়ে রবীন্দ্রনাথের কাছে শান্তিনিকেতনে কবির পাশের বাড়িতে প্রায় তিনমাস ছিলেন সাহানা । সেইসময় রবীন্দ্রনাথ, প্রতিমা দেবী, মীরা দেবী, কমলা দেবীদের আন্তরিকতা ও যত্ন সাহানা দেবী আমৃত্যু স্মরণ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ নিজে “বারবার ঘুরেফিরে দিনের মধ্যে কতবার আমায় দেখতে আসতেন। তাপ দেখতেন কপালে হাত দিয়ে। আর কিসে ভালো হয়ে উঠব তার জন্য কতই না ভাবতেন, কত উদ্বিগ্নই হতেন আমার জীবনের কথা ভেবে”।
১৯২৭ সালের মার্চ মাসে সাহানা দেবী শান্তিনিকেতন থেকে ভাওয়ালি স্যানেটোরিয়ামে যান। কাশী পর্যন্ত তিনি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গেই গিয়েছিলেন। তারপর লক্ষ্ণৌতে পিসতুতো দাদা অতুলপ্রসাদের কাছে কদিন থেকে সাহানা চলে গেলেন ভাওয়ালি। সেখানেও তাঁর শারীরিক উন্নতি না হওয়ায় রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, “তোমার ওজন কমে যাচ্ছে শুনে খুশী হলুম না। কিসের তোমার স্যানিটোরিয়াম। ওর চেয়ে আমাদের সেই ভাঙা খোড়ো চালের ঘরে যে ছিলে ভালো”।
পন্ডিচেরিবাসের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে রবীন্দ্রনাথকে চিঠি লিখলে কবি লিখেছিলেন, “তুমি যে সাধনার ক্ষেত্রেও সাধনার সহায় পেয়েচ সেও তোমার দুর্লভ সুযোগ। এই সুযোগ তোমার জীবনে পরিপূর্ণ সফলতা লাভ করুক এই আমি সর্বান্তঃকরণে কামনা করি’। এরপর আর একটি চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, “তোমাকে দেখবার এবং তোমার গান শোনবার জন্যে ঔৎসুক্য মনে জাগে”।
১৯৩৫/৩৬ সাল নাগাদ নাচ গানের দল নিয়ে বিদেশ যাত্রার সময় প্রতিমা দেবী সাহানা দেবীকে আহ্বান জানান। কিন্তু তিনি তাঁর অক্ষমতা জানিয়ে চিঠি দিলে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “আজ দোলপূর্ণিমার দিন। আমাদের এখানে বসন্তপূর্ণিমা, এই আনন্দের উৎসবে তোমার নির্বাসিত মধুকন্ঠের জন্য বেদনা জেগে উঠল। আর কোনোদিনই কি তোমার সুরের সঙ্গে আমার গানের মিলন হবে না”? না হয়নি। সাহানা দেবী রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে “বিসর্জন” নাটকে অভিনয়ও করেছেন, “কবির ইচ্ছে হল আমাকে দিয়ে এই নাটকে গান গাওয়াবেন”। সঙ্গে সঙ্গে নতুন করে গান রচনা করলেন। সেবারের অভিনয়ে নতুন-পুরনো মিলিয়ে মোট দশটা গান ছিল সাহানা দেবীর। “অভিনয় আরম্ভই হোত আমার 'তিমির দুয়ার খোল এস এস নীরব চরণে’ গানটির সঙ্গে। সেই দশটি গানের পাঁচটি তিনি রবীন্দ্রনাথের কাছে জোড়াসাঁকোর ৬ নং বাড়ির সামনের দিকের বসবার ঘরে বসে শিখেছিলেন। “প্রতিটি গান তিনি নিজে হাতে লিখে দেন”। কবির কাছে তিনি শিল্পী হিসেবে কোন মর্যাদার অধিকারী ছিলেন তা এই আচরণ থেকেই অনুভব করা যায়। এই সময়ই রবীন্দ্রনাথ জানতে পারলেন “দিন ফুরালো হে সংসারী” - গানটি অমলা দাশের কাছে থেকে শিখে নিয়েছিলেন সাহানা দেবী। শুনে পরম আনন্দিত হন কবি। কেননা, “অমলা ছাড়া এ গানটি আর কেউই জানত না”। সেই গানটিও 'বিসর্জন' নাটকে যোগ করেন কবি। অভিনয়ের দ্বিতীয় দিনে সাহানা দেবী প্রবল জ্বর নিয়ে এমন গান গেয়েছিলেন যে অভিনয় শেষে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে বলেছিলেন, “শোন ঝুনু, জ্বর হলে যদি তোমার এমন গান হয়, তবে আমি তোমার জ্বর হয়েছে শুনে দুঃখ করব না, খুশি হব, সে কথা তুমিই বল।” রবীন্দ্রনাথের প্রতিভায় মুগ্ধ ও তাঁর স্নেহস্পর্শে আপ্লুত ছিলেন সাহানা দেবী। তবু অন্য এক জগতের আহ্বানে সাড়া দিয়েছিল তাঁর মন।
সুস্থ হয়ে ওঠার পর বায়ুপরিবর্তনের জন্য সাহানা দেবী বিশাখাপত্তনমে সমুদ্রের ধারে একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে একা কিছুদিন বাস করেছিলেন। সেখানে অতিথি হয়ে গিয়েছিলেন নীরেন রায় ও দিলীপকুমার রায়। এই দুই সুপন্ডিত ব্যক্তির সাহচর্যে সাহানা দেবী আধ্যাত্মিক বিষয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। ১৯২২ সালে গয়া কংগ্রেসে দিলীপকুমারের গান তাঁকে মুগ্ধ করেছিল। এবার তিনি প্রাণিত হলেন দিলীপকুমারের আধ্যাত্মিক চেতনায়। “দিলীপের কাছে যা শিখেছি যা পেয়েছি তা বলতে গেলে কিছুই বলা হয় না। আমি তাঁর কাছে চিরকৃতজ্ঞ।” দিলীপকুমারের সূত্রেই সাহানা দেবীর পন্ডিচেরি যাওয়া। শ্রী অরবিন্দ ও শ্রীমা-র আশ্রয়গ্রহণ। “অতীত জীবনকে বিদায় দিয়ে নামলাম গাড়ি থেকে বাইশে নভেম্বর”। তারপর থেকে জীবনের শেষ অবধি “শ্রীঅরবিন্দ সারণং মম”- ছিল তাঁর একমাত্র চাওয়া।
পন্ডিচেরি থেকে সাহানা দেবী আর কলকাতায় ফিরে আসেননি। তবে গানকে চিরবিদায় তিনি দেননি, দিতে পারেননি। “অতি অল্প বয়েস থেকেই আমি গান গাই। বোধকরি আমার জ্ঞান হওয়া থেকেই সে আমার সাথের সাথী। তাকে ছাড়া চলতে শিখিনি। জীবনের শেষপ্রান্তে এসে দেখি আজও সে রয়েছে আমার পাশে”। অস্তাচলের ধারে এসে এই উপলব্ধি হয়েছিল সাহানা দেবীর। পন্ডিচেরিতে তাঁর কাছে অনেকে গিয়েছেন, গান শুনিয়েছেন, তাঁর কাছ থেকে গান শিখেও এসেছেন। রবীন্দ্রনাথের কিছু গান যা তিনিই জানতেন তা রেকর্ডও করে দিয়েছেন। তবু ফিরে আসেননি। যাঁর প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “আমি যদি সুরলোকের সম্রাট হতাম তবে তোমাকে আমার শান্তিনিকেতনে বন্দী করে নিয়ে আসতাম।” সেই সুরসাধিকা সাহানা দেবী ১৯৯০ সালে পন্ডিচেরিতে ৯৩ বছর বয়সে প্রয়াত হন।