রবীন্দ্রনাথের গানের অনন্য শিল্পীঃ অমলা দাশ


রবীন্দ্রনাথের গান যখন রবীন্দ্রসঙ্গীত হয়ে ওঠেনি, যখন তার পরিচয় সীমাবদ্ধ ছিল ‘রবিবাবুর গানে’ তখন যিনি সর্বসমক্ষে রবীন্দ্রনাথের গান গাইতেন তিনি অমলা দাশ। ‘না শিখেই অমলা যা গাইত, শিখলে সে যে কোন বড় ওস্তাদের সমকক্ষ হতে পারত এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই'। নাটোরের মহারাজা পাখোয়াজবাদক জগদিন্দ্রনাথ রায়ের এই উক্তির আলোয় অমলা দাশের ছবিটি বড় উজ্জ্বল হয়ে ফুটে ওঠে। ভুবনমোহন দাশের কন্যা, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের ভগ্নী অমলা দাশের জন্ম ১৮৭৩ সালে। নিতান্ত অল্পবয়স থেকেই তাঁর সাঙ্গীতিক প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়। সেকালে ভদ্রঘরের মহিলারা কেউ প্রকাশ্যে গান গাইতেন না। অমলা সেই সব বাধা অনায়াসে অতিক্রম করে এইচ. এম. ভি কোম্পানীর প্রথম গায়িকার সম্মান পেয়েছিলেন। তাঁর রেকর্ডে লেখা থাকত 'মিস দাস, অ্যামেচার’পরিবারের বাইরে রবীন্দ্রনাথের গানের প্রথম মহিলা শিল্পী

 

জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে অমলার যোগ ছিল নিবিড়। রবীন্দ্রনাথের পত্নী মৃণালিনী দেবীর সঙ্গে তাঁর গভীর বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল। অমলার ছোটবোন ঊর্মিলা দেবীর স্মৃতিকথা থেকে জানা যায় অমলা শুধু জোড়াসাঁকোয় যেতেন তাই নয়, তিনি কখনও কখনও দু-তিন মাস সেখানে থাকতেন। তাঁর সঙ্গে মৃণালিনী দেবীর এতই ভাব ছিল যে গল্প শুরু হলে আর থামত না। এমনই একদিন, রবীন্দ্রনাথ ঘরে বসে লিখছেন “আর শোবার ঘরে তাঁদের বিছানায় শুয়ে শুয়ে কবিপ্রিয়া আর আমার দিদি খুব গল্প করছেন"।

 

এমন তন্ময় হয়ে গেছেন যে, কবি কখন এসে শিয়রে দাঁড়িয়েছেন কেউ টের পাননি। হঠাৎ মাথার কাছ থেকে বলে উঠলেন,''আমি আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকব? আমার ঘুম পায় না?'' যেমন কথা কানে গেছে দিদি তো বিছানা থেকে লাফিয়ে পড়ে দে-ছুট উঠিপড়ি করে। কবি তখন খুব হাসছেন আর বলছেন, ‘অমলা ও অমলা, অত ছুটো না পড়ে যাবে যে'!"
অমলা রবীন্দ্রনাথকে ডাকতেন 'রবিকাকা’ বলে আর মৃণালিনী দেবীকে ডাকতেন 'কাকীমা’। ১৩০২ সালে রবীন্দ্রনাথ সপরিবারে শিলাইদহ গিয়েছিলেন। অমলাও সঙ্গে গিয়েছিলেন। অক্টোবরের ১৬ তারিখে কবি একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, 'রাত্রি যদিও গভীর ছিল কিন্তু সম্পূর্ণ নিস্তব্ধ ছিল না, কারণ আমার পাশের বোট থেকে দুই প্রতিবেশিনী বিছানায় পড়ে পড়ে হাস্যালাপ করছিলেন'।

 

এই ‘দুই প্রতিবেশিনী' হলেন মৃণালিনী এবং অমলা। মৃণালিনী দেবীর অকালমৃত্যুর পর ইন্দিরা দেবীকে একটি চিঠিতে অমলা লিখেছিলেন, “কাকীমার মতো বন্ধু আমার আর নেই।….. বাপমায়ের সঙ্গে রাগ করে কতবার কতদিন কাকীমার কাছে গিয়ে থেকেছি। যে আংটির কথা লিখেছ সেটা বেশ মনে আছে। …. শমী হবার এক বৎসর আগে শিলাইদহে ওদের সঙ্গে যেবার ছিলুম, একদিন রাত্তিরে বোটের জানালার ধারে বসে আমার হাত থেকে খুলে কাকীমাকে পড়িয়েছিলুম। ওই আংটির সঙ্গে আমার অনেক কথা গাঁথা হয়ে আছে”। তাঁদের এই সুগভীর সখ্য নিয়ে কবি ১৩০২ সালের আশ্বিন মাসে  'ওলো সই, ওলো সই/ আমার ইচ্ছা করে তোদের মতো মনের কথা কই’ - গানটি রচনা করেছিলেন।

 

রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিকথায় আছে, “এই সময়ে( অর্থাৎ ১৮৯৬/৯৭সালে) নতুন গান বাঁধবার জন্য বাবাকে উৎসাহিত করেছিলেন অমলা দিদি, চিত্তরঞ্জন দাশের ভগ্নী। মায়ের সঙ্গে তাঁর খুব ভাব ছিল।…… তাঁর গান গাইবার ক্ষমতার পরিচয় পেয়ে বাবা তাঁকে রাধিকা গোস্বামীর কাছে হিন্দি গান শিখতে দিলেন। অল্পদিনেই ওস্তাদি অনেক গান শিখে নিলেন। অমলাদিদির গলা যেমন অনায়াসে খাদে খেলত তেমনি চড়াতে উঠত। তাঁর গলার উপযোগী গান বাবা রচনা করতে লাগলেন।

 

অমলা দিদি গাইবেন বলে যে গানগুলি বাঁধা হয়েছিল, তার মধ্যে একটা- দুটো মনে পড়ে, যেমন- চিরসখা, ছেড়ো না মোরে ছেড়ো না, এ পরবাসে রবে কে হায়, কে বসিলে আজি হৃদয়াসনে ভুবনেশ্বর প্রভু”। রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনুমান ছিল যে, ' এই গানগুলির সুর রাধিকাবাবুর কাছ থেকে বাবা নিয়ে এসেছিলেন’। অমলা দাশের করা একুশটি রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ডের সন্ধানে পাওয়া যায়।মহর্ষির জীবিতাবস্থায় জোড়াসাঁকোয় খুব সমারোহ করে মাঘোৎসব পালন করা হত। এই উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথ প্রতি বছর নতুন গান রচনা করতেন। যেবার তিনি বেদীতে বসে উপাসনা করতেন সেবার নিজে কোনো গান গাইতেন না। ‘একা গাইবার জন্য কয়েকটি গান দিদিদের মধ্যে ভাগ করে দিতেন। অমলা দিদি যতদিন ছিলেন, তাঁর জন্য দুটি-একটি গান থাকতই’ - জানিয়েছেন রথীন্দ্রনাথ।

 

১৩০৪ বঙ্গাব্দের আশ্বিন মাসেও অমলা দাশ রবীন্দ্রনাথের পরিবারের সঙ্গে শিলাইদহে ছিলেন। রথীন্দ্রনাথের স্মৃতিকথায় আছে, “লেখার ফাঁকে ফাঁকে যখন বাবাকে গানে পেয়ে বসত- অমলা দিদিকে কলকাতা থেকে নিয়ে আসতেন। দিনের বেলায় অমলাদিদি মায়ের সঙ্গে রান্না নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন।– সন্ধে হলেই, অন্য সব কাজ ফেলে গান শোনবার জন্য সবাই সমবেত হতেন। মাঝিরা জলিবোটটা বজরার গায়ে বেঁধে নিয়ে যেত। তাড়াতাড়ি খাওয়া সেরে জানালা টপকে সেই বোটটাতে গিয়ে বসতুম। সুরেনদাদার হাতে এসরাজ থাকত। জলিবোট খুলে মাঝ-দরিয়ায় নিয়ে গিয়ে নোঙর ফেলে রাখা হত। তারপর শুরু হত গান- পালা করে বাবা ও অমলাদিদি গানের পর গান গাইতে থাকতেন।…. সে সব রাত আজ স্বপ্নের মতো মনেহয়। কিন্তু আজও যখন ‘বেলা গেল তোমার পথ চেয়ে', ‘তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা তুমি আমার সাধের সাধনা' প্রভৃতি গান শুনি, সেই সব রাত্রির কথা মনে পড়ে যায়”।

 

রবীন্দ্রনাথের সঙ্গীতজীবনের প্রথম পর্বে “তিনি গান রচনা করতেন একেবারে সুর কথা একসঙ্গে। বড়ো বারান্দায় পায়চারি করতে করতে যেই গান শেষ হল অমনি চিৎকার আরম্ভ করতেন,’অমলা ও অমলা শিগগির এসে শিখে নাও। এক্ষুনি ভুলে যাব কিন্তু’। অমলা শুধু শিখে নিতেন তাই নয়, তাঁর গায়নের অনন্যতায় সে গান অন্য মাত্রা পেত। ইন্দিরা দেবী চৌধুরানীর স্মৃতিচারণে আছে, “….সেকালের আর একজন স্বনামধন্য সুগায়িকার উল্লেখ করি- দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের বোন অমলা দাশ। তাঁর সরু মিষ্টি গলায় যে যথেষ্ট জোর ছিল তা এই বললেই বোঝা যাবে যে, কলকাতার কংগ্রেসে দশ হাজার লোকের সভায় দাঁড়িয়ে উঠে একা ‘বন্দেমাতরম্’ গেয়েছিলেন” ।

 

এই গানটি প্রসঙ্গে অমলার বোনঝি সাহানা দেবী বলেছিলেন, “তাঁর নিজের কন্ঠে তান যে কি অপূর্ব ছিল, দানাগুলি সব যেন আলাদা করে স্পষ্ট হয়ে উঠত। আর কী কন্ঠই ছিল মাসিমার। কোথায় গলা চলে যেত তারা সপ্তকের ধৈবত পর্যন্ত। কলকাতার কংগ্রেসে একবার মাসিমা একা যা ‘বন্দেমাতরম্’ গেয়েছিলেন সেরকম ‘ বন্দেমাতরম্’ গান তারপরে আর কেউ গাইতে পারেননি। তখনকার দিনে মাইক ছিল না, কংগ্রেসের অতবড় প্যান্ডেলে শেষপর্যন্ত মাসিমার গলা পরিষ্কার শোনা গিয়েছিল”।

 

এই গানটির বর্ণনা আছে সীতা দেবীর আত্মকথাতেও- “চিত্তরঞ্জন দাশ মহাশয়ের ভগিনী অমলা দাশ এই গানের নেত্রী ছিলেন। তাঁহার কন্ঠস্বর বর্ণনা করিবার ভাষা নাই,যাঁহারা কোনোদিন উহা শুনিয়াছিলেন তাঁহারা আমার কথা সত্য বলিয়া স্বীকার করিবেন”।
অমলা দাশ ছিলেন সেই বিরল শিল্পীদের একজন তিনি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দ্বৈতসঙ্গীত গেয়েছেন।‘ রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর দ্বৈতসঙ্গীত, তখনকার দিনে যাঁরা শুনেছেন তাঁদের মুখেই শুনেছি যে, সে ভুলবার নয়’।

 

অমলার কন্ঠে ভক্তিরসের গানও হত অপূর্ব। সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের লেখা গানও তিনি গাইতেন। রুমা গুহঠাকুরতার মাতামহ, সতী দেবীর পিতা চারুচন্দ্র দাশ ছিলেন অমলার নিকটাত্মীয়। তাঁর সঙ্গে দ্বৈতসঙ্গীতের বর্ণনা দিয়েছেন সাহানা দেবী। ‘তমীশ্বরাণাম্ পরমং মহেশ্বরম্’ এই বেদগানটি আমরা মাসিমা ও ময়নাদার মিলিতকন্ঠে একাধিকবার শুনেছি।……'য এতদ্বিদুরমৃতাস্তে ভবন্তি’ এই শেষ লাইনটি যখন মাসিমা ময়নাদার সুর থেকে এক সপ্তক উঁচুতে ধরে গেয়ে শেষ করতেন, তার রেশ লেগে থাকত মনে প্রাণে ও কানে বহুক্ষণ ধরে”।

 

অমলা দাশের ব্যক্তিত্বও ছিল অনন্যসাধারণ। চিত্তরঞ্জন দাশের মা নিস্তারিণী দেবীর মৃত্যুর পর সেই বিশাল পরিবারের ভার ছিল তাঁর ওপর। বহুগুণান্বিতা এই নারী ছিলেন অত্যন্ত বুদ্ধিমতী। চিত্তরঞ্জন দাশ বলতেন, 'অমলা যদি ব্যারিস্টার হত তবে ওর সঙ্গে আমরা পেরে উঠতাম কিনা সন্দেহ’। রান্নাও জানতেন খুব ভালো। ইন্দিরা দেবী জানিয়েছেন, 'আমার দাদা সুরেন্দ্রনাথ …….অমলার রান্নার খুব সুখ্যাত করতেন, বিশেষত তাঁর ছানার পায়েসের’। সেকালের মেয়েদের ঘরোয়া খেলা ছিল দশ-পঁচিশ। অমলা নাকি 'ঘর না গুণে কীরকম টপ টপ করে দশ-পঁচিশের ঘুঁটি ঠিক ঠিক জায়গায় বসাতেন, সে একটা দেখবার জিনিস’।

 

তিনি ছিলেন স্বাধীনচেতাআত্মনির্ভরশীল। ‘অল্পবয়স থেকেই নিজে উপার্জন করতেন এবং সেই অর্থে নিজের অনেকখানি খরচ নিজেই চালাতেন’। শেষ জীবনে অমলা তাঁদের পুরুলিয়ার বাড়িতে অনাথ আশ্রম তৈরি করে সেখানে থাকতেন।

 

নাটোর রাজপরিবারের সঙ্গে অমলার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। মহারাজা যোগীন্দ্রনাথ, রাজকুমারী বিভা ছিলেন তাঁর অত্যন্ত স্নেহের। যেমন ছিলেন রবীন্দ্রনাথের পুত্র-কন্যারা। তাঁর শেষশয্যায় শিয়রে দাঁড়িয়ে যোগীন্দ্রনাথ অমলার বড় প্রিয় ‘দীনবন্ধু করুণাসিন্ধু, কৃপাবিন্দু বিতর (দীনে)' গানটি গেয়েছিলেন।

 

১৯১৯ সালে মাত্র বিয়াল্লিশ বছর বয়েসে রসা রোডের বাড়িতে অমলা দাশের জীবনপ্রদীপ নির্বাপিত হয়। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে একবার বলেছিলেন, ”দেখো অমলা মানুষ মরে গেলেই যে সবকিছু হারিয়ে যায়, জীবিত প্রিয়জনের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, সেকথা আমি বিশ্বাস করি না”। অমলা দাশের ক্ষেত্রেও সেকথা বলা চলে। আজও অমলা দাশের গাওয়া উদাত্ত রবীন্দ্রগানের সুর মুগ্ধ করে মরমী শ্রোতাকে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...