বিশুপাগলের দুখজাগানিয়া

রাজা : 'আমি পর্বতের চূড়ার মত '

নন্দিনী : সেই চূড়ার বুকেও ঝর্ণা ঝরে, তোমার গলাতেও মালা দুলবে, জাল খুলে দাও ভিতরে যাবো।

 

হ্যাঁ, ভেঙে চুরমার করে দিতে পারে সে মনের ভিতরের সমস্ত নেতিবাচক চিন্তা। দম্ভের চোখে চোখ রেখে বলতে পারে বেরিয়ে এস পৌষের গান গাই।

এই হলো 'নন্দিনী'। রক্তকরবীর রঙের মতোই তার মন। খোলা হাওয়া সে। এক স্বাধীনচেতা নারীর জ্বলন্ত উদাহরণ। নন্দিনীর সংলাপ, নন্দিনীর মন, নন্দিনীর প্রিয় রক্তকরবী সবই ঘুরে ফিরে আসে আমাদের জীবনে। তাঁর মন কেঁদে ওঠে কিশোরের জন্য, তার বিশু পাগলের সাথে সে গান ধরতে পারে "ভালোবাসি, ভালোবাসি"

এই চরিত্রের স্রষ্টা 'রবীন্দ্রনাথ'। আজ তাঁর ১৫৮ তম জন্মবার্ষিকীতে মনে পড়ছে তাঁর তৈরী এই অসামান্য সৃষ্টি। অবাক হয়ে ভাবতে ইচ্ছা করছে কিভাবে এতো নিপুণভাবে একটি নারীচরিত্র তিনি সৃষ্টি করেছেন।  আজ শুধু নন্দিনীকেই মনে পড়ে না। মনে পড়ে তাঁর লেখা গান,কবিতা। আজ চারিদিকে শুধু রবীন্দ্রনাথ। 

 

"বিশু পাগলের দুখজাগানিয়া "

নন্দিনী। পাগলভাই, এই বন্ধ গড়ের ভিতরে কেবল তোমার-আমার মাঝখানটাতেই একখানা আকাশ বেঁচে আছে। বাকি আর-সব বোজা।

 

নন্দিনী ও বিশু পাগলের কথোপকোথন গভীরভাবে পড়লে মুখে ম্লান হাসি ফোটে। সংলাপের ভেতরে যে কত দর্শন আছে, লুকিয়ে আছে কত শিক্ষা, লুলিয়ে আছে এমন অনেক অনেক কথা যা আমাদের জীবনে আজও যুক্তিসঙ্গত। বিশু পাগল এই যক্ষপুরীর মধ্যেও গোটা এক আকাশ খুঁজে পেত নন্দিনীর জন্য। নিজের মধ্যে যে এখনও আলো  অবশিষ্ট তা সে উপলব্ধি করতে পারে নন্দিনীর জন্যই।

 

"নন্দিনী ও বর্তমান নারী"

রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি যুগের গতির সাথে তাল মিলিয়ে চলে। তাঁর ভাবনা এগিয়ে যায় দূরে অনেক দূরে।  তাই এত এত বছর পরেও তাঁর চরিত্রগুলোর সাথে আজও আমরা মিল খুঁজে পাই। স্বাধীনচেতা নারীর উদাহরণ হিসেবে কোথাও গিয়ে যেন 'নন্দিনী' আমাদের জীবনে ঘুরেফিরে আসে। তাঁর প্রত্যেকটি সংলাপে খুঁজে পাই এক নারী মন। যা প্রত্যেকটা নারীর মধ্যে আছে। বর্তমান সমাজে যখন নারীবাদ ভীষণ মাত্রায় ছড়িয়ে পড়েছে, সেই সময় এসেও নন্দিনী ও রবীন্দ্রনাথ খুবই যুক্তিসঙ্গত।

   'নন্দিনী। আমি এসেছি এখান থেকে তোমাকে বের করে নিয়ে যাব। সোনার শিকল ভাঙব।'

নন্দিনীর মধ্যে আছে প্রতিবাদ। আছে শিকল ভাঙার ইচ্ছে, জালের ভিতরের রাজাকেও সে টলাতে পারে। এইরকম মনই তো চাই বর্তমান সমাজে। এইরকম সাহস চাই, চাই নন্দিনীর মতো জেদ আর ইচ্ছে।

"দেখতে দেখতে সিঁদুরে মেঘে আজকের গোধূলি রাঙা হয়ে উঠল। ঐ কি আমাদের মিলনের রঙ। আমার সিঁথের সিঁদুর যেন সমাপ্ত আকাশে ছড়িয়ে গেছে।"

জালে বন্দি রাজাকে নন্দিনী বলতে পারে বেরিয়ে আসতে দম্ভের চেয়ে সরল হাসি অনেক বড়- তা বলে দিতে পারে সে। যেই রাজকে সবাই ভয়ে করে সেই রাজাকে নন্দিনী বলে ওঠে - "কতবার বলেছি, তোমাকে মনে করি আশ্চর্য। প্রকাণ্ড হাতে প্রচণ্ড জোর ফুলে ফুলে উঠেছে, ঝড়ের আগেকার মেঘের মতো -- দেখে আমার মন নাচে। " 

 

"নন্দিনী চিরকাল থেকে যাক আমাদের মনে"

রবীন্দ্রনাথ আমাদের সবেতে, বাঙালির জীবেনর প্রত্যেক চলাতে তার গান কবিতা মিশে থাকে। নন্দিনীকে নিয়ে এত বলার কারণই হল আজকের সময়। আজকের সময়েও নন্দিনীর আভা আমাদের অনুপ্রাণিত করে।

   কচি কলাপাতার রঙের শাড়ি আর গলায় দুলবে রক্তকরবীর মালা, কানেও থাকবে রক্তকরবী, থাকবে দুই হাতেও। যক্ষপুরীর মতই আমাদের সমাজে থাকুক তার মত এক টুকরো আকাশ, থাকুক তার মত এক টুকরো আলো। থাকুক নন্দিনীর মত দারুণ সংলাপ, থাকুক রঞ্জনের মত এক প্রেমিক। পৌষের গান ধরি এই দিনে। গান ধরি ভালোবাসি ভালোবাসি, চোখ বুঝে ভাবি বিশু পাগলের কথা।

                                              "ওগো ঘুমভাঙানিয়া,

                                         তোমায় গান শোনাবো"

 

 

 

 

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...