উপেক্ষিত অথচ প্রাসঙ্গিক রবীন্দ্রনাথ

বিত্তশালী পরিবারে জন্মগ্রহন করেও একটা ঘর আর জানলায় বাঁধা ছিল রবীন্দ্রনাথের শৈশব, একথা সকলেরই জানা। জ্ঞান-দূরদর্শিতার ঔরসেই জন্ম তাঁর, তার বাইরে শৈশবের সেই বাঁধা পরিবেশ, বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে আলাপ করার প্রবল উৎকন্ঠাই তার স্নায়ুতে জন্ম দিয়েছিল কল্পনা-প্রতিভাকে। ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ ছোটবেলার এই ছন্দমিল বাক্যই ছিল তাঁর কবিতার আদি স্বাদ। সারাজীবন ধরে নিজস্ব প্রতিভার আলোর ছত্রছায়ায় এনেছিলেন বিশ্ববাসীকে। বাংলায় তাঁকে 'গুরুদেব' সম্মোধন করা হত/হয়, শুধু তাই নয় তাঁকে নিয়ে বাঙালির উন্মাদনা এমনই যে তা সময়ে সময়ে চোখে লাগে। বাংলা এবং বাঙালি জাতিকে সর্বব্যাপী করে তোলার পথে তার ভূমিকা অগ্রাহ্য করার নয় বলেই হয়তো বেশিরভাগ বাঙালি তাঁকে গভীরার্থে না উপলব্ধি করেই উন্মাদবৃত্তিতে প্রবৃত্ত হন। তাও ভালো, তাঁকে নিয়ে উন্মাদবৃত্তি করলে ভালো কিছুই ছড়িয়ে পড়বে, তবে তা অসার-ফাঁপা-অন্তঃসারশূন্য ভাবে। গোটা কয়েক গান, উপন্যাস, গল্প, ছড়া -যা নিয়ে মাতলামো করে মানুষ, কিন্তু তার বাইরে ব্যপকার্থে যে রবীন্দ্রনাথ রয়েছেন দুর্ভাগ্যবশত সেসবের চর্চা কস্মিনকালেও শোনা যায় না। এমন একটা ভাব যেন সেসবের প্রয়োজনই নেই, তিনি 'ঠাকুর' এই যথেষ্ট।

গান, উপন্যাস, গল্প, ছড়া বাদে তাঁর দার্শনিকতায় তিনি যে আরও কত মানিক্য-জহরত রেখে গিয়েছেন তা অবহেলিতই হয় সাধারণভাবে, যা আলোকিত হওয়া প্রয়োজন এ'সময়ের নিরিখে। 'দেশ-শিক্ষা-উপায়' নিয়ে তাঁর যে বিস্তৃত দর্শন তা রবীন্দ্রচর্চায় উঠে আসা অত্যাবশ্যক আর সে নিয়েই এই আলোচনা।

এ দেশ সম্পর্কে 'ভারতবর্ষের ইতিহাস' প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, "ভারতবর্ষের প্রধান সার্থকতা কী, এ কথার স্পষ্ট উত্তর যদি কেহ জিজ্ঞাসা করেন, সে উত্তর আছে;  ভারতবর্ষের ইতিহাস সেই উত্তরকেই সমর্থন করিবে। ভারতবর্ষের চিরদিনই একমাত্র চেষ্টা দেখিতেছি,  প্রভেদের মধ্যে ঐক্য স্থাপন করা, নানা পথকে একই লক্ষ্যে অভিমুখীন করিয়া দেওয়া এবং বহুর মধ্যে এককে নিঃসংশয়রূপে অন্তরতররূপে উপলব্ধি করা,-বাহিরে যে সকল পার্থক্য প্রতীয়মান হয়, সেগুলিকে নষ্ট না করিয়া তাহার ভিতরকার নিগূঢ় যোগকে আবিষ্কার করা।

এই এককে প্রত্যক্ষ করা এবং ঐকান্তিক বিস্তারের চেষ্টা করা ভারতবর্ষের পক্ষে একান্ত স্বাভাবিক, তাহার এই স্বভাবই তাহাকে চিরদিন রাষ্ট্র-গৌরবের প্রতি উদাসীন করিয়াছে। কারণ, রাষ্ট্র-গৌরবের মূলে বিরোধের ভাব।"

'বিশ্ববিদ্যালয়' প্রবন্ধে লিখেছেন, "বাংলার আকাশে দুর্দিন এসেছে চার দিক থেকে ঘন ঘোর করে। একদা রাজদরবারে বাঙালীর প্রতিপত্তি ছিল যথেষ্ট। ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রদেশে বাঙালী কর্মে পেয়েছে খ্যাতি, শিক্ষা-প্রসারণে হয়েছে অগ্রণী। সে দিন সেখানকার লোকের কাছে সে শ্রদ্ধা পেয়েছে, পেয়েছে অকুন্ঠিত কৃতজ্ঞতা। আজ রাজপুরুষ তার প্রতি অপ্রসন্ন,  অন্যান্য প্রদেশে তার সম্বন্ধে আতিথ্য সংকুচিত, দ্বার অবরুদ্ধ। এ দিকে বাংলার আর্থিক দুর্গতিও চরমে এলো......

আজ হিন্দুমুসলমানে যে একটা লজ্জাজনক আড়াআড়ি দেশকে আত্মঘাতে প্রবৃত্ত করছে তার মূলেও আছে সর্ব্বদেশব্যাপী অবুদ্ধি। অলক্ষী সেই অশিক্ষিত অবুদ্ধির সাহায্যেই আমাদের ভাগ্যের ভিত্তি ভাঙবার কাজে চর লাগিয়েছে, আত্মীয়কে তুলছে শত্রু করে, বিধাতাকে করছে আমাদের বিপক্ষ। ...

শেষকালে নিজের সর্ব্বনাশ করবার জেদ এতদূর পর্যন্ত আজ এগোলো যে বাঙালী হয়ে বাংলা ভাষার মধ্যেও ফাটল ধরাবার চেষ্টা আজ সম্ভবপর হয়েছে, শিক্ষার ও সাহিত্যের যে উদার ক্ষেত্রে সকল মতভেদ সত্ত্বেও এক-রাষ্ট্রীয় মানুষের মেলবার জায়গা, সেখানেও স্বহস্তে কাঁটাগাছ রোপণ করবার উৎসাহ ব্যথা পেল না, লজ্জা পেল না। দুঃখ পাই তাতে ধিক্কার নেই কিন্তু দেশজোড়া অশিক্ষাগ্রস্ত হেয়তা আমাদের মাথা হেঁট করে দিল, ব্যর্থ করে দিল আমাদের সকল মহৎ উদ্যম। রাষ্ট্রিক হাটে রাষ্ট্রাধিকার নিয়ে দরদস্তুর করে হট্টগোল যতই পাকানো যাক, সেখানে গোলটেবিলের চক্রাবাত্যায় প্রতিকারের চরম উপায় মিলবে না, তরীর তলায় যেখানে বাঁধন আলগা সেইখানে অবিলম্বে হাত লাগাতে হবে।"

'ছাত্রদের প্রতি সম্ভাষণ' প্রবন্ধে, "আমাদের প্রথমবয়সে ভারতমাতা, ভারতলক্ষী প্রভৃতি শব্দগুলি বৃহদায়তন লাভ করিয়া আমাদের কল্পনাকে আচ্ছন্ন করিয়াছিল। কিন্তু মাতা যে কোথায় প্রত্যক্ষ আছেন, তাহা কখনো স্পষ্ট করিয়া ভাবি নাই-লক্ষ্মী দূরে থাকুন,  তাঁহার পেঁচ’কটাকে পর্য্যন্ত কখনো চক্ষে দেখি নাই। আমরা বায়রনের কাব্য পড়িয়াছিলাম, গারিব্লডির জীবনী আলোচনা করিয়াছিলাম এবং প্যট্রিয়টিজমের ভাবরস-সম্ভোগের নেশায় একেবারে তলাইয়া গিয়াছিলাম।

'আইডিয়া' যত বড়োই হউক, তাহাকে উপলব্ধি করিতে হইলে একটা নির্দিষ্ট সীমাবদ্ধ জায়গায় প্রথম হস্তক্ষেপ করিতে হইবে। তাহা ক্ষুদ্র হউক, দীন হউক, তাহাকে লঙ্ঘন করিলে চলিবে না। দূরকে নিকট করিবার একমাত্র উপায় নিকট হইতে সেই দূরে যাওয়া। ভারতমাতা যে হিমালয়ের দুর্গম চূড়ার উপরে শিলাসনে বসিয়া কেবলই করুণসুরে বীণা বাজাইতেছেন, এ-কথা ধ্যান করা নেশা করা মাত্র-কিন্তু ভারতমাতা যে আমাদের পল্লীতেই পঙ্কশেষ পানাপুকুরের ধারে ম্যালেরিয়াজীর্ণ প্লীহারোগীকে কোলে লইয়া তাহার পথ্যের জন্য আপন শূন্যভান্ডারের দিকে হতাশদৃষ্টিতে চাহিয়া আছেন, ইহা দেখাই যথার্থ দেখা। যে ভারতমাতা ব্যাস-বশিষ্ঠ-বিশ্বামিত্রের তপোবনে শমীবৃক্ষমূলে আলবালে জলসেচন করিয়া বেড়াইতেছেন, তাঁহাকে করজোড়ে প্রণাম করিলেই যথেষ্ট, কিন্তু আমাদের ঘরের পাশে যে জীর্ণ চীরধারিনী ভারতমাতা ছেলেটাকে ইংরেজি বিদ্যালয়ে শিখাইয়া কেরাণিগিরির বিড়ম্বনার মধ্যে সুপ্রতিষ্ঠিত করিয়া দিবার জন্য অর্দ্ধাশনে পরের পাকশালে রাঁধিয়া বেড়াইতেছেন, তাঁহাকে তো অমন কেবলমাত্র প্রণাম করিয়া সারা যায় না।"

এই হল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দুরদর্শীতা, সময় যে আবর্তিত হয় এবং আবর্তিত সময়কে যুগে যুগে একইরকম দেখতে লাগে এই প্রবন্ধগুলি তারই প্রামান্য দস্তাবেজ। তিনি তাঁর সময়ে যা বলে গিয়েছেন, সে সময়ের পুনরাবৃত্তি এখনও। তাঁর সময়ের অন্যতম মুক্তি-মুখ ছিলেন তিনি, তাঁর জন্মদিন উপলক্ষে এ সময়েরও মুক্তি-মুখ হয়ে উঠুন রবীন্দ্রনাথ।   

 

 

 

 

 

 

 

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...