ভোজনবিলাসী রবিঠাকুর

রবীন্দ্রনাথ আমদের প্রিয় কবিগুরু, তাঁকে নিয়ে আমাদের কৌতূহলের অন্ত নেই। রবীন্দ্রনাথের জীবনের বিভিন্ন দিকের অন্যতম একটি হল রবীন্দ্রনাথের খাদ্যপ্রীতি! রবীন্দ্রনাথ খেতে খুব ভালবাসতেন এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত খাবারের প্রতি তাঁর ভালোবাসা অক্ষত ছিল। এই প্রসঙ্গে কবির, জনপ্রিয় কয়েকটি পঙতি উল্লেখ করা যেতে পারে; যেখানে তিনি প্রাতরাশের বিভিন্ন খাদ্য সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন-

'আমসত্ত্ব দুধে ফেলি, তাহাতেই কদলী দলি।

সন্দেশ মাখিয়া দিয়া তাতেই হাপুস-হুপুস শব্দ।

চারিদিক নিঃশব্দ। 

পিঁপড়ে কান্দিয়া যায় পাতে'।

কবিগুরু সারাদিনে বেশ কয়েকবার খেতেন। তিনি ভোরবেলায় খুব তাড়াতাড়ি উঠে পরতেন, এক কাপ চা অথবা কফি খেতেন আর তাঁর নিমের শরবত খাওয়া তো লোকের মুখে মুখে ঘোরে। দিনের শুরু হত ওই নিমের শরবত দিয়েই! তিনি প্রাতঃরাশে ভেজা বাদাম, মধু সহযোগে টোস্ট এবং এক কাপ দুধ খেতেন। আবার মাঝে মাঝে ছোটবেলার প্রিয় খাবার সন্দেশ, কলা, দুধে ফেলে মেখে খেতেন। সকাল দশটা নাগাদ তিনি লেবুর রস খেতেন, এবং মধ্যাহ্নভোজনে রবীন্দ্রনাথ ভাত খেতেন, যদিও খুব অল্প পরিমাণে। বিকেলে কবির জন্য বরাদ্দ ছিল মুড়ি ও চা। কবির রাতের খাবারে থাকত সব্জির স্যুপ, লুচি ও তরকারী। রবীন্দ্রনাথ দুপুরের খাবার পরিবারের সকলের সঙ্গে ঘরের মেঝেতে বসে খেতেন কিন্তু রাতের বেলায় তিনি খেতেন ডায়নিং টেবিলে বসে। আমিষ ও নিরামিষ সব ধরনের খাবারই রবীন্দ্রনাথের পছন্দের খাবারের তালিকায় ছিল। দেশী বিদেশী সব খাবারই ছিল তার কাছে সমাদৃত, তাঁর প্রিয় খাবারের তালিকায় ছিল ব্রিটিশ পদ, আপেল দিয়ে রান্না খাসীর মাংস, তুর্কী কাবাব।

তিনি বিদেশে গিয়ে যে খাবার খেতেন, সেগুলির রান্না পদ্ধতি জেনে এসে ঠাকুর বাড়ির রান্না ঘরে সেগুলি রান্না করার অনুরোধ করতেন। বাড়ির মেয়েরা রান্না নিয়ে প্রচুর পরীক্ষা–নিরীক্ষা চালাতেন, নতুন নতুন খাবারের পদ তৈরিতে তারা সব সময় ব্যস্ত থাকতেন। রবীন্দ্রনাথের স্ত্রী মৃণালিনীদেবীর একটি আলাদা রান্নাঘর ছিল,তাঁর রান্না খাতার কথাও বেশ জনপ্রিয়। অতিসাধারণ উপাদান যেমন পটল ও আলুর খোসা দিয়েও তিনি সুস্বাদু পদ তৈরি করতেন। কবির স্ত্রী মৃণালিনী দেবীর রান্না ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলে খুব জনপ্রিয় ছিল। তার হাতের রান্না খেতে সবাই খুব পছন্দ করতেন, বিশেষত দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি নাকি টকের সঙ্গে ঝাল মিশিয়ে বেশ নতুন নতুন পদ তৈরি করতেন। বাইরের খাবার খেলেও বাড়িতে কবি কম তেল-মশলাযুক্ত খাবার খেতেন, তিনি রাত দুটোর সময়ও মৃণালিনী দেবীকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে কিছু রান্না করে খাওয়াতে বলতেন এবং শোনা যায় এই ঘটনা নিয়মিত ঘটত আর মাঝরাতে মৃণালিনী দেবী রান্না করে রবীন্দ্রনাথকে খাওয়াতেন।

মৃণালিনী দেবীর হাতে তৈরি দেশি খাবারের মধ্যে তিনি পছন্দ করতেন কাঁচা ইলিশের ঝোল, চিতল মাছ আর চালতা দিয়ে মুগের ডাল এবং নারকেল চিংড়ি। তিনি কাবাব খেতে খুব পছন্দ করতেন। এর মধ্যে ছিল শ্রুতি মিঠা কাবাব, হিন্দুস্তানি তুর্কি কাবাব, চিকেন কাবাব নোসি। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে এখনও সযত্নে রক্ষিত আছে মৃণালিনী দেবীর রান্নাঘর। সেখানে রয়েছে তার ব্যবহৃত একটি উনুন, আর বেশ কিছু চিনামাটির বাসন। ঠাকুরবাড়ির রান্নায় বেশি করে মিষ্টি দেওয়ার প্রচলন ছিল। গরম মশলা, লবঙ্গ, দারুচিনি বেশি পরিমাণে ব্যবহৃত হত। রান্নার তালিকায় প্রতিদিনই প্রচুর পদ থাকত। নিয়মিত অবশ্যই থাকত সুক্তো আর দইমাছ। ঠাকুরবাড়ির নিজস্ব কিছু মৌলিক পদ ছিল, যার অধিকাংশ হারিয়ে গেলেও বেশ কিছু সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। সেগুলি আজও রয়ে গিয়েছে; কলকাতার কিছু নামি রেস্তোরায় দেখা মেলে ঠাকুর বাড়ির বিভিন্ন পদের।

মাত্র ১২ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ প্রথমবার বাবা; মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে দেশভ্রমণে বের হন। তারপর বহু দেশ ঘুরেছেন। আর প্রতিটি দেশে ভাল লাগা খাবারগুলো সময় সুযোগমতো ঠাকুরবাড়ির হেঁসেলে চালু করে দিতেন কবি। যেমন ইউরোপের কন্টিনেন্টাল ডিশের একটি ফ্রুট স্যালাড ঠাকুরবাড়িতে চালু করেছিলেন তিনি। রবীন্দ্রনাথের একটি স্বাভাব ছিল তিনি দেশে বিদেশে যেখানেই নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে যেতেন সেখানকার মেনুকার্ড সংগ্রহ করতেন এবং এই ঘটনা থেকেই রবীন্দ্রনাথের খাদ্যপ্রীতির পরিচয় পাওয়া যায়।

বাঙালি খাবারের মধ্যে, কৈ মাছের পদ, চিতল মাছের পেটি ভাজা, ভাপা ইলিশ, ফুলকপি দিয়ে তৈরি নানান পদ ছিল রবীন্দ্রনাথের খুব প্রিয়। মিষ্টির মধ্যে পায়েস, চন্দ্রপুলি, ক্ষীর, নারকেল দিয়ে তৈরি মিষ্টি, দইয়ের মালপোয়া, চিঁড়ের পুলি, মানকচুর জিলিপি, রাঙা আলুর পান্তুয়া, আমসত্ত্ব ইত্যাদি খেতে খুব ভালবাসতেন তিনি। তবে পায়েস ও পিঠে পুলির প্রতি কবির বিশেষ আকর্ষণ ছিল।

রবীন্দ্রনাথের ফলের প্রতিও তীব্র অনুরাগ ছিল। দুপুরের খাওয়ার আগে তিনি নিয়মিত ফল খেতেন যেমন পাকা পেপে, কলা, বাতাবি লেবু ,আম। এই আম ছিল রবীন্দ্রনাথের অত্যন্ত প্রিয় ফল। কবি আম কেটে খেতে পছন্দ করতেন না তিনি আম চুষে খেতেন। কবি কাঁচা আম খেতেও খুব ভালবাসতেন। আচারও ছিল তাঁর পছন্দের তালিকায়, কাদম্বরী দেবী কবিকে লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁচা আম এনে দিতেন।আম আর রবিঠাকুরের অনুরাগ নিয়ে একটি কিংবদন্তি কাহিনী রয়েছে, টমি ওয়াডা নামে এক জাপানী ভদ্র মহিলার আমন্ত্রণে দ্বিতীয়বার কবি জাপানে যাওয়ার কথা ভাবতে থাকেন, কিন্তু সেটি আমের সময় ছিল। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন আমের ভিড়, ফলে পাকা আমেরপ্রীতি তার জাপান যাওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। অবশেষে ঠিক হয় বরফ বাক্সে করে আমও কবির সাথে জাপান পাড়ি দেবে।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজ হাতে রান্নাও করতেন। আমরা অনেকেই জানি না তাঁর রন্ধনপ্রীতি সম্পর্কে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেড়ানোর সময় সেসব জায়গার নিজস্ব খাবারের প্রতি তাঁর অনুরাগ জন্ম নেয়, তার থেকে কোন কোনটি আবার পরবর্তী সময়ে তাঁর প্রিয় খাবারের তালিকায় স্থান পেয়েছে। যেমন: প্যাটিস, স্যুপ, পাই, কাটলেট, রোস্ট, কাবাব ইত্যাদি। ঠাকুরবাড়ির পাকঘরের ঠাকুরদের দিয়ে দেশি এবং বিদেশি রান্নার ফিউশন করিয়েছেন, যা থেকে জন্ম নিয়েছে নতুন স্বাদের খাবার। এরই মধ্যে সেগুলো নিয়ে রন্ধনশিল্পীরা বেশ কিছু বইও প্রকাশ করেছেন। ঠাকুরবাড়িতে সবাইকে নিয়ে কবি একসঙ্গে চা চক্রে চা খেতে বসতেন। কবি জাপানি চা পছন্দ করতেন কেবল তাই নয়, সঙ্গে তাদের চা খাওয়ার রেওয়াজটিও ছিল তাঁর পছন্দের। তিনি জাপানে গেলে প্রায় প্রতিদিনই তার জন্য 'টি সেরিমনি' আয়োজন করতেন গুণমুগ্ধরা।

১৯১৩ তিনি নোবেল পুরস্কার পান। ঠিক তার আগের বছর ১৯১২ সালে লন্ডনে 'গীতাঞ্জলি'র ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয়। ওই দিনের অনুষ্ঠান আয়োজন করেছিল ইন্ডিয়ান সোসাইটি, লন্ডন। সেদিনের খাদ্য তালিকা হয়েছিল কবির পছন্দে। ওই দিন খাবারের তালিকায় ছিল গ্রিন ভেজিটেবল স্যুপ, ক্রিম অব টমেটো স্যুপ, স্যামন ইন হল্যান্ডেন সস এ্যান্ড কিউকামবার, প্রি সলটেড ল্যাম্ব উইথ গ্রিন ভেজিটেবল, রোস্ট চিকেন, ফেঞ্চ ফ্রাই, গ্রিন স্যালাড ও আইসক্রিম।

রবীন্দ্রনাথ, তাঁর আইসক্রিমপ্রীতির জন্যেও পরিচিত ছিলেন, তাঁর রসবোধ ছিল মারাত্মক। কবিগুরুর, আইসক্রিম প্রেম আর রসবোধের মিশেলে এক কিংবদন্তি রয়েছে, একবার কবি ভক্ত আর ছাত্রছাত্রীদের সামনে গাইছেন, "হে মাধবী, দ্বিধা কেন" তখন ভৃত্য বনমালী আইসক্রিমের প্লেট নিয়ে ঘরের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। বনমালী ভাবছে ঘরে ঢুকবে কি ঢুকবে না। কারণ রবীন্দ্রনাথ গান গাইছেন, এ সময় বিরক্ত হবেন কি না কে জানে। গুরুদেব বনমালীর দিকে তাকিয়ে গাইলেন, "হে মাধবী, দ্বিধা কেন"। বনমালী আইসক্রিমের প্লেট গুরুদেবের সামনে রেখে লজ্জায় ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। রবীন্দ্রনাথ পরক্ষণেই বললেন, "বনমালীকে যদিও মাধবী বলা চলে না। তবে তার দ্বিধা মাধবীর মতোই ছিল। আর আইসক্রিমের প্লেট নিয়ে দ্বিধা করা মোটেই ভালো নয়।"

শেষ করি, বাঙালির সনাতনী আবহমানকাল ধরে চলে আসা খাদ্য তালিকার সর্বশেষ সদস্য পান দিয়ে, কবিগুরু ছিলেন পানের ভক্ত। মশলাদার মিষ্টি পান ছিল তাঁর পছন্দের, দুপুরের খাবার পর তিনি প্রায়শই পান খেতেন। তাঁর নাতজামাই তাঁকে একটি পানদানি উপহার দিয়েছিলেন, যা আজও ঠকুরবাড়িতে রাখা রয়েছে আছে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...