২২শে শ্রাবণ বাঙালীর দুঃখের দিন। সেদিন আকাশ জুড়ে কান্না নামে, সেই কান্না এসে থামে আমাদের চোখে। গুরুদেব এদিনই ফিরে গিয়েছিলেন সৃষ্টিলোকে, দিক শূন্যপুরের ঠিকানায়। ১৯৪১ সালের ৭ই আগস্ট, বাংলা পাঁজি অনুযায়ী দিনটা ছিল ২২শে শ্রাবণ। বাঙালীর মন কেমনের দিন। এই তারিখটি বললেই, আহিরীটোলা থেকে আয়ারল্যান্ড, মেলবোর্ন থেকে ময়নাগুঁড়ি সর্বত্র বাঙালীর মন জুড়ে দুঃখ নেমে আসে। গুরুদেবের শরীর আগে থেকেই খারাপ ছিল। সেদিন সকালেও ডা: বিধানচন্দ্র রায় ও ডা: ললিত বন্দ্যোপাধ্যায় এসে দেখে গিয়েছিলেন কবিগুরুকে। নতমস্তকে বিদায় নিয়েছিলেন, তাঁরা জানতেন কী হতে চলেছে।
ভারাক্রান্ত হৃদয়ে তখন জোড়াসাঁকোয় বসে সকলে। অমোঘ সত্যি শোনার অপেক্ষায়। ওদিকে বারবার নির্মলকুমারীর কাছে লোক আসতে লাগল। তাঁকে ওখানে থেকে সরিয়ে নিয়ে যেতে। কিন্তু তিনি যাবেন কী করে, গুরুদেব যে মৃত্যু পরবর্তী কিছু ইচ্ছের কথা কেবল নির্মলকুমারীকেই বলে গিয়েছিলেন। তাঁরই তো দায়িত্ব, সেই সব ইচ্ছে পূরণ করতে হবে যে,গুরুদেবের দেওয়া গুরুদায়িত্ব। এর মধ্যেই হঠাৎ ফোন এলো গুপ্তনিবাস থেকে...ঐ সময় সেখানেই থাকতেন মহলানবিশরা। বাড়িতে হয়তো কিছু ঘটেছে,এমনটাই খবর পেলেন নির্মলকুমারী। অগত্যা গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেলেন তড়িঘড়ি। গিয়ে দেখলেন, সবই ঠিক আছে। বুঝতে দেরি হল না যে ঐ ফোনটি ভুয়ো ছিল। ফের রওনা দিলেন, যখন জোড়াসাঁকো পৌঁছলেন, তখন দেখলেন লোকে লোকারণ্য।
রবি ঠাকুরের যখন শরীর খুব খারাপ অর্থাৎ ওই দিন বেতারকেন্দ্রের তরফে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, প্রতি ১৫ মিনিট অন্তর অন্তর কবির স্বাস্থ্যের খবর জানানো হবে বেতারে। যাতে কবির অনুরাগী শ্রোতাদের দুশ্চিন্তা দূর হয়। সেই মতো জোড়াসাঁকো থেকে খবর বেতার অফিসে পৌঁছাতে থাকল। সম্প্রচার করছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। এক সময় এল সেই চরম সংবাদ। ঘড়িতে তখন ঠিক দুপুর ১২টা বেজে ১৩ মিনিট। খবর পৌঁছল বেতারকেন্দ্রে চলে গিয়েছেন তিনি। ভারতের রবি অস্ত গেলো। নিভে গেল প্রদীপ। বেতার কেন্দ্র ঠিক করল, কবির অন্তিম যাত্রার ধারাবিবরণী শোনানো হবে। এই প্রথমবারের জন্যে কারোর শবযাত্রার ধারাবিবরনী রেডিওতে বাজল। পরিকল্পনার নেপথ্য ছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের। টেলিফোনে একদিকে খবর নিচ্ছেন আর অন্যদিকে যাত্রার বিবরণ শোনাচ্ছেন। সেই ধারাবিবরণীর প্রথম দিকের কথাগুলো ছিল-"ঠাকুরবাড়িতে বেশিক্ষণ শবদেহ রাখার রীতি নেই, বিশেষত মধ্যাহ্নে যিনি প্রয়াণ করেছেন বিকেলের মধ্যে তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন করতেই হবে। সংবাদ সংগ্রহ করতে করতে আমরাও নিমতলা শ্মশানে এসে হাজির। ও পারে দূরের ওই নীলাকাশে অস্তগামী সূর্য শেষ বিদায়ের ক্ষণে পশ্চিম দিগন্তে ছড়িয়ে দিল অগ্নিবর্ণ রক্তিম আভা, আর এপারে এই পৃথিবীর বুকে বহ্নিমান চিতার লেলিহান অগ্নিশিখায় পঞ্চভূতে বিলীন হল এক মহপ্রাণের পূত-পবিত্র শরীর। রবি গেল অস্তাচলে...।"
ধারাভাষ্যকারের সঙ্গেই সম্প্রচারিত হল বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের কণ্ঠ, সঙ্গে স্বরচিত কবিতার চরণ... 'ঘুমাইতে দাও শ্রান্ত রবিরে'। সশরীরে না হলেও বেতার মাধ্যমে অজস্র লোক হেঁটে চললেন শেষের যাত্রায়। কবিকে হয়তো বললেন, সাবধানে যেও। যাত্রা শুভ হোক। কিন্তু কেমন ছিল এই শবযাত্রা?
শেষ যাত্রায় রওনা হওয়ার আগে রবি ঠাকুরের মরদেহকে স্নান করানো হচ্ছে, তখনই ঢুকে পড়ে একদল লোক। আশ্চর্যের বিষয় হলেও, সত্যি তাঁদের কেউ কোনোরকম বাধা দেয়নি। রবি ঠাকুরকে সাজিয়ে যখন শেষ সজ্জায় শায়িত করা হল, তখন বাড়ির পরিজনদের সামনেই একদল লোক এসে কবির দেহ তুলে নিয়ে চলে গেল। সামান্য সহবত শিষ্টাচার পর্যন্ত তারা দেখাননি। বাইরে তখন শোনা যাচ্ছে, 'জয় রবীন্দ্রনাথের জয়! জয় বিশ্বকবির জয়!'। এই সব কিছুই হয়তো জোড়াসাঁকোর ভেতরের কবি পরিবারের মানুষদের কাছে কাঁটার ন্যায় বিঁধছিল।
এইখানে বিতর্কও বেঁধে ছিল, শনিবারের চিঠির সম্পাদক সজনীকান্ত দাসের বয়ানে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছিল। ঐতিহাসিকভাবে কবিগুরুর শেষযাত্রায় বিশৃঙ্খলার কথা জানা যায়, সেই সময়েই তিনি শনিবারের চিঠি-এর সম্পাদকীয়তে এই সমস্ত ঘটনা অস্বীকার করেছিলেন। কেবল অস্বীকার করেই তিনি ক্ষ্যান্ত হননি, তিনি এও বলেছিলেন এরকম কোনো ঘটনা ঘটেনি। এও বলেছিলেন ইচ্ছে করেই এই সব রটানো হচ্ছে। কিন্তু এই বক্তব্যের হেতু আজও উদ্ধার করা যায়নি। এই শোক যাত্রায় রবীন্দ্রনাথের শরীর মাটিস্পর্শ করেনি, একথা সর্বৈব সত্য।
আবার সেই সঙ্গে এও সত্যি যে কবির মরদেহের ওপরে কম অত্যাচারও করা হয়নি। কেউ কেউ তাঁর চুল-দাড়ি ছিঁড়ে নিয়েছিলেন। কেউ কেউ আবার প্রণাম করার অছিলায় তাঁর পায়ের নখ পর্যন্ত তুলে নিয়েছে। গোটা রাস্তা জুড়ে শুধু মানুষের মাথা,ভিড়ে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। লোকে লোকারন্য। তিল ধারণের জায়গা নেই, ভিড়ে আসতে পারেননি রথীন্দ্রনাথ। আজ্ঞে হ্যাঁ। ছেলে বাবার মুখাগ্নি করতে পারেননি। কবি গুরুর মুখাগ্নি হয়নি ছেলের হাতে। এই বিষয়ে রাণী চন্দ লিখেছিলেন – 'রথীদা যাচ্ছেন। 'মুখাগ্নি' কথাটা উচ্চারণ করতে আর পারলেন না। বললেন, আমি যাচ্ছি—তুমিও চলো। ...একটা মোটরে, বাড়ির মোটরই হবে, রথীদার সঙ্গে আমরাও উঠলাম। ...ভিড়ের চাপে মোটর চলে না—আমরা নেমে পড়লাম। নিশ্ছিদ্র ভিড় নিমতলা ঘাটের পথে। রাম অধিকারী মশায় দু হাতে রথীদাকে আগলে ধরে ভিড় ঠেলে এগোবার চেষ্টা করতে লাগলেন।— রাম অধিকারী মশায়ের দেহে যেমন গলায়ও তেমনি জোর। তিনি চীৎকার করে ভিড়ের উদ্দেশে বলতে লাগলেন, আপনারা একটু পথ ছেড়ে দিন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয়ের পুত্র রথীন্দ্রনাথ এসেছেন পিতার কাজ করতে—আপনারা একটু পথ দিন। রাম অধিকারী যতই চেঁচাচ্ছেন ভিড় ততই চঞ্চল হয়ে উঠছে—কোথায় রবীন্দ্রনাথের পুত্র—তাঁকে দেখবে তারা। মুহূর্তে ভিড়ে যেন উত্তাল তরঙ্গ জাগল। আর উপায় নেই ঘাটে যাবার। রথীদা শোকে অসুখে কাহিল ছিলেন, এবারে যেন সম্বিৎ হারিয়ে পড়ে যাবার মতো অবস্থা হল।"
শোভাযাত্রা বিকেল তিনটের সময় শুরু হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু ভিড়ের দাপটে রাত আটটা নাগাদ শেষকৃত্যের কাজ শুরু হয়েছিল। সেই জনসমুদ্রে ভেসে ফিরে গেলেন কবি। মুখাগ্নি করলেন ঠাকুর বংশের পৌত্র সুবীরেন্দ্রনাথ ঠাকুর। যেখানে রবীন্দ্রনাথকে দাহ করা হয়, সেখানেই তাঁর স্মরণে একটি স্মৃতিফলক দেখা যায়। তাতে লেখা – 'অনায়াসে যে পেরেছে ছলনা সহিতে/সে পায় তোমার হাতে/শান্তির অক্ষয় অধিকার।' কবির ইচ্ছা ছিল, তাঁর মৃত্যুর পর এই গান যেন গাওয়া হয়। তাঁর ইচ্ছেকে শ্রদ্ধা জানিয়ে নিমতলা মহাশ্মশানে তাঁর স্মৃতিফলকে এই চরণ গুলি ঠাঁই পেয়েছে।